রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা ও কলেজছাত্রী তাসনিয়া ইসলাম প্রেমা পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিলেন কক্সবাজার। একই মাইক্রোবাসে এ যাত্রায় সঙ্গে ছিলেন বাবা রফিকুল ইসলাম শামীমের সহকর্মী দিলীপ বিশ্বাস ও তার পরিবার। পরিকল্পনা ছিল কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সবাইকে নিয়ে ঘুরবেন এবং ঈদের আনন্দ উপভোগ করবেন; কিন্তু এই আনন্দভ্রমণ পরিণত হয়েছে বিষাদে। কক্সবাজার যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় রকিফুল ও দিলীপের পরিবারসহ ১০ জন মারা গেছেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে আছেন প্রেমা ও আরাধ্য বিশ্বাস। তাদের চিকিৎসা চলছে আইসিইউতে। তারা এখনো জানে না তাদের বাবা-মাসহ পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই।
গত বুধবার সকালে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে কক্সবাজারগামী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন মাইক্রোবাসে থাকা রফিকুল ইসলাম (৪৮), তার স্ত্রী লুৎফুন নাহার (৩৭), ছোট মেয়ে লিয়ানা ও ভাগনি তানিফা ইয়াসমিন। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যায় মেজ মেয়ে আনিশাও। সড়ক দুর্ঘটনায় ওই পাঁচজন ছাড়া মাইক্রোবাসে থাকা আরও নিহত পাঁচজন হলেন দিলীপ বিশ্বাস (৪৩) ও তার স্ত্রী সাধনা মণ্ডল (৩৭), আরও দুই সহকর্মী আশীষ মণ্ডল (৫০) ও মোক্তার আহমেদ (৫২) এবং মাইক্রোবাসের চালক ইউছুফ আলী।
দুর্ঘটনায় দিলীপের মেয়ে আরাধ্য বিশ্বাস (৮) গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) ভর্তি আছে। সে এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে শিশু আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ৭২ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
একই অবস্থা প্রেমারও। তিনিও একই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন। লাইফ সাপোর্টে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়া হচ্ছে তাকে। দুর্ঘটনার পর থেকে এখনো তেমন সাড়া দিচ্ছেন না।
গতকাল বিকেলে চমেক হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় ৬৩ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন আরাধ্যর মামাতো ভাই দুর্জয় কুমার বিশ্বাসকে। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে তিনিও একজন। তার বাঁ হাত ও ডান পায়ে বড় ধরনের চিড় ধরেছে। মাথায় আঘাত রয়েছে। কুষ্টিয়ার একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র দুর্জয়।
দুর্জয়ের পাশে বসে থাকতে দেখা যায় তার আত্মীয় জগদীশকে। তিনি দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঝিনাইদহ থেকে ছুটে এসেছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, দুর্জয়ের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না। তার বাবা নেই। পরিবারে মা আর দুই বোন আছে। ভিটেমাটি ছাড়া তাদের আর কোনো সহায়-সম্বল নেই। তার উন্নত চিকিৎসার সব ব্যবস্থা যেন সরকার করে।
শিশু আইসিইউতে কর্তব্যরত চিকিৎসক কালবেলাকে বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আরাধ্যকে আইসিইউতে আনা হয়েছে। আপাতত তাকে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এর আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
শিশু আইসিইউর সামনে পাওয়া গেল আরাধ্যর চাচা অসিত কুমার বাড়ইকে। তিনিও শৈলকুপা থেকে এসেছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, আরাধ্যর পরিবারে এখন আর কেউ নেই। আপাতত আরাধ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় আছি আমরা। সে সুস্থ হলে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সে কোথায় থাকবে।
আইসিইউর সামনে নির্বাক হয়ে বসে থাকতে দেখা গেল প্রেমার ফুফাতো ভাই বদিউলকে। তিনি বলেন, আরাধ্যর বাবা আর প্রেমার বাবা একই কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে তারা কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। প্রেমার বাবা-মা, দুই বোন ও ফুফাতো বোন মারা গেছেন। তারা মিরপুরে থাকেন। মরদেহ সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রেমার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে আইসিউতে চিকিৎসক কালবেলাকে বলেন, প্রেমা মাথা, পাঁজর ও পায়ে আঘাত পেয়েছে। পাঁজর ও পায়ে ফ্রাকচার হয়েছে। কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। অবস্থা উন্নতির দিকে গেলে লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, আরাধ্য ও প্রেমা দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আইসিইউতে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে দুর্জয়ের অবস্থা কিছুটা ভালো।
আহতদের দেখতে হাসপাতালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ও চসিক মেয়র:
সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে এবং তাদের চিকিৎসা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীরপ্রতীক ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তারা চিকিৎসাধীন রোগীদের অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন করে স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন।
মন্তব্য করুন