চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি বিভিন্ন ফোরাম থেকে ক্রমাগতভাবে জানিয়ে আসছে বিএনপি। অবশ্য ডিসেম্বরে না হয়ে তার দু-এক মাস পরে নির্বাচন হলেও তা নিয়ে এতদিন দলটির অনাপত্তির যে অবস্থান ছিল, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের নানামুখী বক্তব্য ও অবস্থানে সেখান থেকে সরে আসছে বিএনপি। বরং ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে ধীরে ধীরে অনড় অবস্থানের দিকে যাচ্ছে তারা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটিকে দলের অনড় অবস্থানেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন অনেকে। দলটি মনে করে, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। ফলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সংস্কারের দীর্ঘসূত্রতায় কার্যত দলটি বিরক্ত। সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের জন্য আগামী দুই মাস (জুন ও জুলাই) অপেক্ষা করবে বিএনপি। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া না হলে রাজপথে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন আদায় করে নেওয়ার পথে হাঁটতে পারে তারা। তবে দলটি এখনো আশা করছে, সরকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খুব কম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংস্কার ইস্যুতে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আজ অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। তারা যে দ্রুততম সময়ে সংস্কার শেষ করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায়, ড. ইউনূসের সামনে তা ফের তুলে ধরবে।
এর আগে গত ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকেও বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানিয়েছিল। দলটি তখন আরও বলেছিল, নির্বাচন দিতে বিলম্ব হলে দেশে নানা সংকট দেখা দিতে পারে। সেটার জন্য সরকার দায়ী থাকবে। তবে ডিসেম্বরে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে তখন বিএনপিকে কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। ড. ইউনূস তার আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করে সেখানে বলেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। পরবর্তী সময়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক থেকেও প্রধান উপদেষ্টা কোনো বার্তা দেননি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পর নির্বাচন নিয়ে সরকারের এমন অবস্থানে ক্ষুব্ধ বিএনপি।
এদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাপান সফরে গিয়ে বলেন, দেশের সব রাজনৈতিক দল নয়, শুধু একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের এ বক্তব্যে বিএনপির অভ্যন্তরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিএনপিকে বিব্রত করার জন্য সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের কথা বলা হয়েছে বলে মনে করে দলটি। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে দলটি। বিভিন্ন ফোরাম থেকে জোরালোভাবে এর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। একই সঙ্গে বিএনপিসহ অর্ধশত রাজনৈতিক দল যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়, সেটাও বারবার সামনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি আসলে সরকারকে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে, নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সরকার যদি তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা না করে, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালবেলাকে বলেন, দেশের মানুষ এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায়। নির্বাচনে যত বিলম্ব হবে, পরিস্থিতি তত ঘোলাটে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নন্দিত ব্যক্তি, নিন্দিত হবেন। এতে করে পতিত স্বৈরাচারী শক্তির সুবিধা হবে। তবে আমরা আশা করি, সরকার দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করবে, দেশকে নির্বাচনমুখী করবে।
অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি সত্ত্বেও সরকার কেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দিচ্ছে না কিংবা সরকার কেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন দিতে চায়—সেটি নিয়ে বিএনপি এখন বিচার-বিশ্লেষণ করছে। দলটির অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। বিএনপি প্রথমত মনে করে, সরকারের ভেতরে কারও কারও এমন শঙ্কা রয়েছে যে, নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং নির্বাচন প্রলম্বিত করে বিএনপিকে কীভাবে চাপে রাখা যায়, সরকারের ভেতরের কেউ কেউ সে প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রবল চাপ রয়েছে। যাতে করে নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য সারা দেশে তারা সংগঠনকে গুছিয়ে নিতে পারে। তৃতীয়ত, বিএনপির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, যেমন বিএনপি সংস্কারের বিরোধী। তারা সংস্কার নয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। বিএনপি মনে করে, নির্বাচনের মাঠে তাদের ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার এটি একটি প্রয়াস। এমন প্রোপাগান্ডা চালিয়ে কোনো কোনো মহল দীর্ঘমেয়াদি কোনো একটা লক্ষ্য অর্জন করতে চায়—যেটা সামগ্রিক মেকানিজমেরই অংশ।
এমন অবস্থায় বিএনপি মনে করছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন এবং বিচারকার্য দৃশ্যমান করে আগামী দুই মাসের মধ্যে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হলে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া হয়তো অন্য কোনো পথ খোলা থাকবে না। সেই রাজনৈতিক কর্মসূচি কোন প্রক্রিয়ায়, কীভাবে, কখন পালিত হবে— বিষয়টি নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা এরই মধ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছেন। ঈদুল আজহার পর এ প্রক্রিয়া আরও বেশি ত্বরান্বিত হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপের জন্য বিএনপি দুই মাস দেখার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকারকে চাপে রাখতে এ সময়ের ভেতরেও কিছু কর্মসূচি আসতে পারে। তবে সেটা সরাসরি নির্বাচন ইস্যুতে হবে না। আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে দলের সাংগঠনিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এ কর্মসূচি আসতে পারে। যেখান থেকে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জোরালোভাবে দলীয় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হবে।
মন্তব্য করুন