নতুন পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর পুলিশপ্রধান (আইজিপি) থেকে শুরু করে থানার ওসি পর্যন্ত সব কর্মকর্তাই থানাকে সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন। পুলিশ ও জনগণের সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকেন তারা। কিন্তু থানায় পুলিশ-জনতার সেতুবন্ধনের মধ্যে প্রভাবক হয়ে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে আরেকটা শ্রেণি; যারা দালাল হিসেবে পরিচিত। গত বছর সরকার পতনের পর থানাগুলোয় এসেছে পুলিশের নতুন মুখ, তবে আগের মতোই প্রতিবন্ধক হিসেবে থেকে গেছে দালালদের দৌরাত্ম্য। অবশ্য মুখ বদলেছে তাদেরও।
গত বছরের ৫ আগস্টের ধাক্কার পর থানাগুলোর নতুন কার্যক্রমেও যে পুলিশ-জনতার সম্পর্কের মধ্যে দালালদের দেয়াল রয়েছে, তা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস বিভাগের (আইএডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ডিএমপির এই উইং গোপনে ঢাকা মহানগরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কার্যক্রম নজরদারি করে থাকে এবং সরাসরি পুলিশ কমিশনারের কাছে প্রতিবেদন দেয়। আইএডির প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০টি থানায় ২১৩ জন নতুন দালাল সক্রিয় রয়েছে। তালিকা ধরে এসব দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডিএমপির আটটি ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনারদের নির্দেশ দিয়েছে ডিএমপি সদর দপ্তর।
ওই প্রতিবেদনটি ধরে কালবেলার পক্ষ থেকে কয়েকটি থানায় সরেজমিন অনুসন্ধান করেও নতুন দালালদের অপতৎপরতা তথ্যের সত্যতা মেলে। ২৬ মে, রাত প্রায় ৯টা। ডিএমপির মোহাম্মদপুর থানার সামনের বাতিগুলো না জ্বালানোয় বেশ অন্ধকার। থানার মূল ফটক ও আশপাশের এলাকায় চার-পাঁচজন করে মানুষের বেশ কয়েকটি জটলা (দল)। যাদের সবাই কথা বলছিলেন ফিসফাস করে। আশপাশে অপরিচিত কাউকে দেখলেই আলাপ থামিয়ে স্থান পরিবর্তন করার চেষ্টায় ছিলেন তারা। এক পর্যায়ে একটি জটলার সবাই ঢুকে গেলেন থানার ভেতরে। পুরো দল থেকে তিনজন ঢুকলেন একটি কক্ষে, বাকিরা বাইরে অবস্থান করছিলেন। সেখানে কথা হয় তাদের একজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার ভাগিনাকে নারীঘটিত ঝামেলায় চল্লিশ ফিট এলাকা থেকে ধরে এনেছে পুলিশ। আমরা থানার কিছু বুঝিও না, কাউকে চিনিও না। তাই এলাকার একজন ‘মুরুব্বিকে’ নিয়ে এসেছি। উনিই সব কাজ করে দিচ্ছেন। তিনি এলাকার প্রভাবশালী ও বিএনপি করা লোক। আশা করি দ্রুতই ছাড়া পাবে ভাগিনা।’ নাম-পরিচয় জানতে চাইলে অনাগ্রহ দেখান তিনি। একটু পরই বেরিয়ে এলেন আহসান উল্লাহ নামের সেই মুরুব্বি, থাকেন বছিলা চল্লিশ ফিট হাউজিংয়ে। ধরে আনা আসামির স্বজনদের অনুরোধ ও পুলিশের ডাকে থানায় এসেছেন। ‘নারীঘটিত ঝামেলার’ বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করছেন। কত টাকায় মীমাংসা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেশি টাকা লাগে নাই। বিষয়টি মোটামুটি মীমাংসা হইছে।’
রাত সাড়ে ১০টার পর বন্ধ করে দেওয়া হলো থানার মূল ফটক। ততক্ষণে বাইরে জটলা বেড়েছে আরও। এমনই একটি জটলায় চার-পাঁচজন উর্দু ভাষাভাষী নারী-পুরুষ। তারা থানার সীমানা প্রাচীরের গ্রিল ধরে ভেতরের দিকে মুখ করে ‘কুতুব ভাই’ নামে একজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। সঙ্গের এক যুবকের কাছে জানতে চাওয়া হলো, কুতুব কি পুলিশের লোক? জবাব দিলেন, ‘না, ওই ভাই পুলিশ না, উনি আমার লোক। ভেতরে আমাদের লোক আছে। তাই উনার হেল্প নিচ্ছি।’
কুতুব ভাই কি লোক ছাড়িয়ে নিতে সহায়তা করছেন?—এমন প্রশ্নে কিছুটা ইতস্ততবোধ করলেন জটলার একজন। তখন পাশে থাকা এক নারী বলে ওঠেন, ‘আরে না, আমরা সামনে দেখলাম, তাই ডাক দিয়েছি।’ কিছুক্ষণ পর কুতুব নামে সেই ব্যক্তি এসে জটলার সবার উদ্দেশে বললেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করতাছি। দেখি কী হয়। ওর (আটক ব্যক্তি) নামে মামলা না থাকলেও বিষয়টি সহজ হইব না।’ কুতুবের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়েই দ্রুত চলে গেলেন ডিউটি অফিসারের কক্ষে।
মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের সদস্যদের কাছেই জানা গেল, মুরুব্বি পরিচয় দেওয়া আহসান উল্লাহ ও কুতুব এলাকায় কিছু ঘটলেই থানায় যাতায়াত করেন। পুলিশের দুজন সদস্য জানালেন, থানা এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক ও গ্রেপ্তার করে আনা আসামিদের ছাড়াতে, মামলা করতে বা তুলতে তারা নানা তদবির করেন। তাদের মতো আরও লোকজন আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শুধু আহসান উল্লাহ বা কুতুব নন, মোহাম্মদপুর থানা ঘিরে সক্রিয় অন্তত ১৪ জন দালাল।
থানা ঘিরে যে এই দালাল চক্র, তা স্বীকারও করলেন মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান। তিনি বলেন, ‘এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত আছে।’
পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, আগে থানা ঘিরে যে দালাল চক্র ছিল, তাদের বেশিরভাগই তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ, সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী পরিচয়ে থানায় প্রভাব বিস্তার করতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুরোনো সেই দালালরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এরপর নতুন দালালরা ভিড়তে থাকে। তারাও পরিচয় দেয় রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীর। থানায় প্রভাব বিস্তার করা রাজনৈতিক দলের পরিচয় দেওয়া এ গ্রুপটি মূলত ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যায়ের নেতাকর্মী। তবে নিজেদের আরও প্রভাব জাহির করতে কখনো কখনো তারা দলের বড় কোনো কোনো নেতার নাম ধরেও নিজেদের তদবির নিশ্চিত করতে চায়।
যদিও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের দাবি, থানায় এখন আর দালাল নেই। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা তো জানি, পাঁচ আগস্টের পরে সব থানা দালালমুক্ত হয়েছে। এখন আর কোনো দালালই নাই।’
দালাল বেশি তেজগাঁও বিভাগের ছয় থানায়: ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ছয়টি থানায় সক্রিয় ৪৫ জন দালালের তালিকা করা হয়েছে। এই বিভাগের থানাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪ দালাল সক্রিয় মোহাম্মদপুর থানায়। বাদবাকিদের মধ্যে ১২ দালাল তেজগাঁও থানায়; এ ছাড়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাতজন, হাতিরঝিল থানায় একজন, শেরেবাংলা নগর থানায় ছয়জন এবং আদাবর থানায় সক্রিয় পাঁচ দালাল।
থানাগুলোয় দালালের দৌরাত্ম্য এবং তা বন্ধে ডিএমপি সদর দপ্তরের নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের তেজগাঁও ডিভিশনের তালিকা ও হেডকোয়ার্টারের নির্দেশনা পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেহেতু তারা সরাসরি থানাগুলো দেখে (তদারকি) থাকেন।’
দালালদের রাজনৈতিক পরিচয় এবং মোহাম্মদপুর থানায় সক্রিয় দালালদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো কাউকে ধরি নাই। ধরলে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা যাবে।’
বিএনপির নাম ব্যবহার করে ৬ জনের নিয়ন্ত্রণে রমনা ও শাহবাগ: ডিএমপির রমনা বিভাগের ছয়টি থানায় সক্রিয় বিশজন দালাল। তাদের মধ্যে শাহবাগ থানার দুজনের একজন নিজেকে পরিচয় দেন ওয়ার্ড বিএনপির পদধারী নেতা হিসেবে। রমনা থানায় দালাল হিসেবে তালিকায় নাম ওঠা পাঁচজনই দলটির অঙ্গসংগঠনের পদধারী এবং সবাই সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত। পুলিশের তালিকাতেই ২০ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মো. রুবেল রমনা থানায় দালাল হিসেবে সক্রিয় বলে উল্লেখ রয়েছে। একই ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য হুমায়ুন কবির, মো. জাকির হোসেন, বিএনপির কর্মী মো. লিটন ও যুবদল কর্মী মোস্তফা হাওলাদারের নামও রয়েছে এ তালিকায়। তারা থানার আশপাশে ফটোকপি, স্টেশনারি বা চায়ের দোকানে নিজেদের আস্তানা গড়ে তুলেছেন। সেখানে বসেই কথা বলেন ভুক্তভোগী বা থানায় ধরে নিয়ে আসা লোকজনের স্বজনদের সঙ্গে। তারপর থানার সংশ্লিষ্ট কর্তাদের সঙ্গে করেন দেনদরবার।
থানাটির পাশে একটি দোকানে পান-সিগারেট বিক্রি করেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য হুমায়ুন কবির। যার সুবাদে থানার অন্দরের প্রায় সব খবরই তার জানা। গত বছরের ৫ আগস্টের পরে নিজের দলীয় পদের নাম ব্যবহার করে তিনি নানা অবৈধ কাজে থানায় আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমি বিএনপি করলেও কোনো পদে নেই। থানার পাশে আমার পান-সিগারেটের দোকান। থানায় যারা আসে সবাই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি কোনো দালালির সঙ্গে যুক্ত নই।’ কথায় কথায় জানালেন, দালাল তালিকায় নাম আসা বাকিদেরও চেনেন। একই ওয়ার্ড শাখা বিএনপির সদস্য জাকির হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয় রমনা থানায় নিয়মিত যাতায়াত করেন কি না? জবাবে যাতায়াতের কথা স্বীকার করেন। তবে দালালের তালিকায় নাম থাকা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই থানায় যাতায়াতের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ওগুলা করি না।’ কালবেলার পক্ষ থেকে তালিকায় নাম আসা অন্যদের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।
শাহবাগ থানার দালালের তালিকায় নাম আসা দুজনের একজন শাহবাগ থানা বিএনপির ২১ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সদস্য সচিব মো. সাগর। তিনি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে থানায় নানা ধরনের তদবির করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে সাগর বলেন, ‘প্রয়োজন না থাকলে তো আমি থানায় যাই না। আমি কোনোদিন কাউকে ছাড়াতে, ধরতে কোনো ধরনের তদবির করিনি।’ দালাল হিসেবে নাম এসেছে শাহবাগ পাইকারি ফুল মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক মো. মনসুরের। থানা সংলগ্ন মার্কেট ঘিরে গড়ে তুলেছেন তার দালালির বলয়। তবে তিনিও দালালির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি ৫ তারিখের (গত বছরের ৫ আগস্ট) পরে দুই দিনও শাহবাগ থানায় যাইনি। দালালি কি জিনিস সেইটা আমি জানিই না।’
এ দুজনের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ওসি মো. খালিদ মনসুর শুরুতে দুজনকে চিনতে পারেননি, তবে ধারণা করতে পেরেছেন বলে জানান। ওসি বলেন, ‘তারা হয়তো এগুলো করতে পারে; কিন্তু কোনো দিন আমার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। আমি খোঁজখবর নিচ্ছি। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের (দালালি) প্রমাণ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ছাড়া তালিকা অনুযায়ী ডিএমপির রমনা বিভাগের ধানমন্ডি থানায় তিনজন, কলাবাগান থানায় দুজন এবং নিউমার্কেট ও হাজারীবাগ থানায় চারজন করে দালাল সক্রিয়। এসব দালাল ও ডিএমপি সদর দপ্তরের নির্দেশনার বিষয়টি অবগত আছেন বলে জানান রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এগুলো আপেক্ষিক কাজ। দালালদের ব্যাপারটি আমাদের নলেজে আছে এবং এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট থানাগুলোয় জানানো হয়েছে। দালাল বলতে তো প্রতারণা বোঝায়, তারা টাকা-পয়সা নিয়ে থানায় নানা কাজ করে। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সুযোগ নেই। তবুও কেউ করে থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
বাকি ছয় বিভাগের মধ্যে বেশি দালাল লালবাগের ছয় থানায়: ডিএমপির লালবাগ বিভাগে ছয়টি থানায় সক্রিয় ৩৮ দালাল। এর মধ্যে ১০ জন রয়েছে কামরাঙ্গীরচর থানায়। এ ছাড়া বংশাল থানায় চারজন, সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি থানায় সাতজন করে এবং চকবাজার ও লালবাগ থানায় পাঁচজন করে দালাল সক্রিয়। মিরপুর বিভাগের সাতটি থানায় সক্রিয় ৩২ দালাল। এসব থানার মধ্যে মিরপুর মডেল থানায় ৯ জন, ভাসানটেকে চারজন, কাফরুল, দারুসসালাম ও শাহআলী থানায় তিনজন করে এবং পল্লবী থানায় চার দালাল সক্রিয়। গুলশান ও ওয়ারী বিভাগে ৬টি করে থানা রয়েছে। এ দুই বিভাগের থানাগুলোতেও ২৬ দালাল সক্রিয়। উত্তরা বিভাগের ছয়টি থানায় ১০ জন এবং মতিঝিল বিভাগের সাতটি থানায় সক্রিয় ১৬ দালাল, যাদের নাম উঠে এসেছে ডিএমপির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদনে।
যেভাবে গড়ে ওঠে এই দালাল চক্র: ডিএমপির চারটি থানা ঘুরে এবং থানাগুলোয় কর্মরত তিনজন উপপরিদর্শক (এসআই) ও চারজন সহকারী উপপরিদর্শকের (এএসআই) সঙ্গে কথা হয়। তারা নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, পুলিশের এলাকাভিত্তিক নজরদারি, তথ্য সংগ্রহ কিংবা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাতে স্থানীয় কিছু লোক দরকার হয়। তাদের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ তৈরি ও এক ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। থানা-পুলিশের প্রয়োজনে ব্যবহার করা এই যোগাযোগগুলো এক সময় নানা তদবির ও অনুরোধ নিয়ে আসে। এর বাইরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরও থানাকেন্দ্রিক তদবিরের একটা বলয় তৈরি হয়।
পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমেই যে এই দালাল চক্রের একটা অংশ সক্রিয় থাকার সুযোগ পায়, তা বেরিয়ে আসে পুলিশের সাত কর্মকর্তার ভাষ্যে। এর সত্যতা মেলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার ও অতিরিক্ত আইজিপি নাঈম আহমেদের কথাতেও। পুলিশের শীর্ষপর্যায়ের সাবেক এই কর্মকর্তা জানান, থানাগুলোতে দালাল চক্র গড়ে ওঠার পেছনে পুলিশের নমনীয়তা কাজ করে।
তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘পুলিশ যদি দালালদের প্রশ্রয় না দেয় তাহলে তো দালালরা প্রশ্রয় পাবে না। দালালদের মাধ্যমে যেন কাজ করতে না হয় ও পুলিশ যেন তাদের প্রশ্রয় না দেয় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। দালালের মাধ্যমে থানায় কাজ করা উচিত নয়।’
থানাগুলো কি দালালমুক্ত করা সম্ভব: থানাগুলো দালালমুক্ত করা সম্ভব কি না—এমন প্রশ্ন ছিল সাবেক সচিব ও অতিরিক্ত আইজিপি নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার কাছে। এক সময় পুলিশ সংস্কার ও পুলিশ প্রবিধানের এসব বিষয় নিয়ে কাজ করা সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘থানাগুলো দালালমুক্ত করা কঠিন। এটা করতে হলে সুপারভিশন (তদারক) ও কন্ট্রোলিং (নিয়ন্ত্রণ) কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা আর কঠোর মনোভাব থাকতে হবে। থানাগুলোর দালাল চিহ্নিত করে পোস্টার সাঁটিয়ে দিতে হবে দেয়ালে। দালালদের থানায় ঢুকতে না দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলেই থানা হবে দালালমুক্ত।’
ডিএমপির সাবেক কমিশনার নাঈম আহমেদেরও মত একই ধরনের। তিনি বলেন, এজন্য তদারকি কর্মকর্তাদের কঠোর হতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির যে কথা বলা হয়, সেটি দালাল চক্রের কারণে ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন সমাজ ও অপরাধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘থানায় সেবা নিতে আসা ভুক্তভোগীরা এসব দালালের খপ্পরে পড়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। মামলায় নিরপরাধ মানুষের নাম ঢুকিয়ে কিংবা অপরাধীর নাম বাদ দিয়ে বাণিজ্য করাসহ নানা অপরাধ করে এসব চক্র। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসব চক্রের সঙ্গে সরাসরি পুলিশের সম্পৃক্ততা থাকে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে থানাগুলো দালালমুক্ত হবে—এমন প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু সেটি হয়নি।’
মন্তব্য করুন