পতিত হাসিনা সরকারের গদি টিকিয়ে রাখতে র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছে গুলি। সেই গুলিতে ছাদের ওপরে থাকা শিশু, এমনকি ঘরের জানালার কাচ ভেদ করে মানুষ হত্যার অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) যার প্রমাণও পেয়েছে। গত বছরের ১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেলিকপ্টার ওড়ানোর একটি গোপন নথি এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে দেখা গেছে, এ চার দিনে র্যাবের হেলিকপ্টার ওড়ানো হয়েছে ২৪ বার। এ সময় ২৬ ঘণ্টা ২৫ মিনিট আকাশে ছিল হেলিকপ্টার। সংস্থাটির হিসাবেই এ সময়ে হেলিকপ্টার থেকে ১ হাজার ৫৪২ রাউন্ড গ্যাসগান ও সাউন্ড গ্রেনেড ফায়ার করা হয়েছে। তবে গুলি ছোড়ার বিষয়টি সেখানে উল্লেখ নেই।
নথিপত্রে দেখা গেছে, ১৮ জুলাই রাজধানীতে হেলিকপ্টার ওড়ানো হয়েছে সাতবার। এদিন ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট আকাশে উড়েছে হেলিকপ্টার। এর মধ্যে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে উদ্ধার অভিযানে ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ওড়ানো হয় প্রথম দফায়। এরপর অগ্নিসংযোগ এলাকা রেকি (পরিদর্শন) করতে হেলিকপ্টার ওড়ানো হয় ৩ দফায় ৯০ মিনিট। রাত্রিকালীন টহলের জন্য দুই দফায় ওড়ানো হয় ৭০ মিনিট। সেতু ভবনের উদ্ধার কাজে ওড়ানো হয় ১০ মিনিট। এদিন কোনো গোলাবারুদ ফায়ার করার তথ্য পাওয়া যায়নি।
নথির তথ্য অনুসারে, ১৯ জুলাই হেলিকপ্টার ওড়ানো হয় সাতবার। এদিন সাতবারে ৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট ওড়ানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট ওড়ানো হয় রেকি ও মব ডিসপার্সমেন্টের উদ্দেশ্যে। একই কারণে আরও ৩ দফা হেলিকপ্টার ওড়ানো হয় ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। অগ্নিসংযোগ এলাকা রেকির জন্য ওড়ানো হয় ৪০ মিনিট। রাত্রিকালীন টহলের জন্য ২ দফায় ওড়ানো হয় ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। এদিন ৩৪০ রাউন্ড গ্যাসগান ও সাউন্ড গ্রেনেড ফায়ারের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২১৮ রাউন্ড গ্যাসগান ও ১২২ রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয় ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে। এদিন ১৩টি শটগানের জন্য ২৬০ রাউন্ড বুলেট নেওয়া হলেও সেগুলো ফায়ার করা হয়নি হেলিকপ্টার থেকে। এ ছাড়া চারটি এসএমজির জন্য ২৪০ রাউন্ড বুলেট নেওয়া হলেও সেগুলো অবশিষ্ট দেখা গেছে গোপন প্রতিবেদনে।
২০ জুলাই হেলিকপ্টার ওড়ানো হয়েছে ছয়বার।
এদিন ৭ ঘণ্টা ১০ মিনিট হেলিকপ্টার ওড়ানো হয়েছে। প্রথম দফায় দিনে টহলে ৫৫ মিনিট হেলিকপ্টার ওড়ানো হয়। এরপর রেকি ও মব ডিসপার্সমেন্টে দুই দফায় ওড়ানো হয় ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট। এরপর তেজগাঁও-নারায়ণগঞ্জ-তেজগাঁওয়ে রেকি এবং মা-হসপিটালে উদ্ধারকাজে হেলিকপ্টার ওড়ানো হয় দুই দফায়। প্রথম দফায় ১ ঘণ্টা ও দ্বিতীয় দফায় ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। এরপর রেকি ও মব ডিসপার্সমেন্টে রাজধানীতে ওড়ানো হয় আরও ৩৫ মিনিট। ২০ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে ৬৬৪ রাউন্ড গ্যাসগান ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫১২ রাউন্ড গ্যাসগান ও ১৫২ রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড। তবে ৮০ রাউন্ড শটগানের বুলেট ও ৬০ রাউন্ড এসএমজি বুলেট হেলিকপ্টারে থাকলেও সেগুলো ফায়ারের তথ্য নেই। এসব বুলেট অবশিষ্ট দেখা গেছে, কালবেলার হাতে আসা গোপন প্রতিবেদনে।
২১ জুলাই চার দফায় হেলিকপ্টার ওড়ানো হয় ৭ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। এদিন প্রথম দফায় গ্রাউন্ড পেট্রোল এয়ার সাপোর্ট, রেকি ও মব ডিসপার্সমেন্টের উদ্দেশ্যে তেজগাঁও-গাজীপুর রোড এলাকায় ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট হেলিকপ্টার ওড়ানো হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় রেকি ও মব ডিসপার্সমেন্টে ওড়ানো হয় ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। মহাপরিচালকের মিশনে ওড়ানো হয় আরও ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। র্যাব ফোর্সেসের জনবল স্থানান্তরে তেজগাঁও-নরসিংদী স্টেডিয়াম-তেজগাঁওয়ে ওড়ানো হয় ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। এদিন র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে ৫৩৮ রাউন্ড গোলাবারুদ ফায়ার করা হয়। এর মধ্যে ২৫৫ রাউন্ড গ্যাসগান ও ২৮৩ রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড ফায়ার করা হয়। এ ছাড়া হেলিকপ্টারে ২০ রাউন্ড শটগানের বুলেট ও ৬০ রাউন্ড এসএমজি বুলেট থাকলেও সেগুলো ফায়ার করা হয়নি।
জুলাই-আগস্টে আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, আন্দোলন দমনে নির্বিচারে গুলির যে নির্দেশ বা পরিকল্পনা ছিল, অধীন কর্মকর্তাদের দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) হারুন অর রশীদ। যে কারণে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
হেলিকপ্টারের ব্যবহার নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করেছে ওএইচসিএইচআর। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভের সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছিল। বিশেষ করে, র্যাবের কালো হেলিকপ্টার বিক্ষোভকারীদের ভীতি প্রদর্শন এবং তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। সিনিয়র কর্মকর্তাদের মতে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশেষভাবে আরও বেশি হেলিকপ্টার মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে র্যাবের আগের কৌশলের মতোই বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানো যায়।
এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্নজনের সাক্ষী নিয়েছে ওএইচসিএইচআর। সেই সাক্ষ্য অনুযায়ী, ১৮ জুলাই মিরপুর ও মহাখালী, ১৮ ও ১৯ জুলাই ধানমন্ডি, ১৯ জুলাই বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, রামপুরা ও শাহবাগ, ১৯ জুলাই এবং ২ ও ৩ আগস্ট বসুন্ধরা, ২০ জুলাই গাজীপুর এবং ২০ ও ২১ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে বারবার র্যাব বা পুলিশের হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ১৮ জুলাই রামপুরায় সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছিল।
সাক্ষীদের ভাষ্যমতে, ১৯-২১ জুলাইয়ে বাড্ডা, বসুন্ধরা, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মহাখালী, মোহাম্মদপুর এবং রামপুরায় হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল বা শটগানের মাধ্যমে প্রাণঘাতী গোলাবারুদ নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ৫ আগস্ট যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় একজন ব্যক্তি আর্মার-পিয়ার্সিং গুলির টুকরোর আঘাতে আহত হন, যা পরে ওএইচসিএইচআর দ্বারা পরীক্ষা করা হয়।
এ ঘটনায় প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিক্ষোভকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো স্বভাবতই নির্বিচার, যা মানবাধিকার মানদণ্ডের লঙ্ঘন। এক সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, এ ধরনের অস্ত্র নির্দিষ্টভাবে এমন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে ব্যবহার করা সম্ভব নয়, যারা সরাসরি মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের আসন্ন হুমকি সৃষ্টি করছে।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘যেহেতু এটি তদন্তাধীন বিষয়, তাই এটা নিয়ে আমার মন্তব্য করার সুযোগ নেই। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে যখন যে ধরনের তথ্যই চাওয়া হয়, র্যাবের সদর দপ্তর থেকে সে তথ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেওয়া হচ্ছে।’
মন্তব্য করুন