আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে দিনের পর দিন গোপন বন্দিশালায় চলত নির্যাতন, জিজ্ঞাসাবাদ। ভাগ্যক্রমে যারা বেঁচে যেতেন, তাদের নামে মামলা দিয়ে উপস্থাপন করা হতো আদালতে। সেখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার পরিবর্তে বিচারকরা দিতেন এসব গুমের বৈধতা। গুম ব্যক্তিকে মিথ্যা মামলায় আদালতে হাজির করা হলে জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায়ের ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন কিছু বিচারক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দেওয়া গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস কালবেলাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বাংলাদেশে একটা গুমের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছিল। এ কাজে সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িয়েছে। বিচার বিভাগও বাদ যায়নি। ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে তৎকালীন সরকার। তাকে হয়তো মেরে ফেলছে না; কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভুয়া মামলা দিয়ে জেলে পাঠাচ্ছে। ভুয়া মামলাগুলোর কারণে ভুক্তভোগীর সুনাম নষ্ট হয়, চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়। এ অবস্থাগুলো সৃষ্টি করে বিচার বিভাগকে একটি অস্ত্র বানানো হয়েছিল। সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা লুকানোর কোনো সুযোগ নেই।’
মানবাধিকারকর্মী ও গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন কালবেলাকে বলেন, ‘যারা গুম করেছেন, তারা তো অপরাধ করেছেনই। বিচারকদের অনেকে এই অপরাধীদের সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করে গেছেন। যা আমরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি।’
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে গুম করার পর তাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আদালতে উপস্থাপন, রিমান্ড আবেদন, জবানবন্দি প্রদান, বিচারের নামে বছরের পর বছর আটকে রাখার প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে করা হতো।
শেখানো বর্ণনামতো জবানবন্দির জন্য হুমকি: দীর্ঘদিন গুম করে রাখা ভুক্তভোগীদের স্পষ্টভাবে বলা হতো, তারা ১৬৪ ধারায় তাদের শেখানো মতো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দিলে কঠিন ফল ভোগ করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সতর্ক করা হতো, নির্দেশিত বর্ণনা অনুযায়ী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দিলে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে বা আরও গুরুতর সাজানো মামলায় জড়ানো হবে।
একজন অভিযোগকারী কমিশনকে জানিয়েছে, তারা একটি কাগজ লিখে দিয়েছেন, ‘এভাবে তুমি স্বীকারোক্তি দিবা। আর না হলে তোমাকে বাঁচায় রাখব না। মেরে ফেলব।’
ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি প্রথমবার দিতে চাইছিলাম না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ডাক দিয়ে বললেন, ‘আপনাদের আসামি তো ভালো করে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে না।’ তারপর উনারা আমাকে বাইরে নিয়ে গেছেন। বাইরে নিয়ে গিয়ে শাসিয়েছেন। আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে কেঁদে কেঁদে বললাম, স্যার, আমাকে আমার ভাইয়ের কাছে যেতে দেন। আমার ছোট ছোট ভাইয়ের জন্য মনটা, প্রাণটা কাঁদছে। আমার মায়ের জন্য কাঁদছে। আমার মায়ের কাছে যেতে দেন।’
মুখস্থ করানো জবানবন্দি: দীর্ঘদিন গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার পর গুমকারীরা ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়ে তা মুখস্থ করাতেন। এই মুখস্থ করানো বক্তব্য জবানবন্দি হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বলতে হতো এবং সেখানে বলা লাগতো যে ভুক্তভোগী সেচ্ছায় এই বক্তব্য দিচ্ছে।
কমিশনকে একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, ওই বিভিন্ন জিনিস লেখাইছে, মুখস্থ করাইছে, বলছে এগুলো বলবি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে। নাইলে কিন্তু যতবার খুশি, ততবার আমরা রিমান্ডে আনব।
আরেকজন বলেন, শেষের চার দিন সময় দিছে, ‘তোমারে চার-পাঁচ দিন সময় দিলাম, এটা মুখস্থ করবা। তুমি এই কথাগুলোই বলবা। না বললে তোমারে পাঁচ-সাতটা মামলা দিয়া দিমু। যদি বলো তাহলে একটা ছোট্ট মামলা দিয়া ছেড়ে দিমু।’
আইনের অনুপস্থিতি: কমিশন জানিয়েছে, ভুক্তভোগীদের প্রায়ই কোনো আইনজীবীর সাহায্য ছাড়াই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য উপস্থিত হতে বাধ্য করা হতো। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, তা তুলে ধরে একজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘জজ সাহেব বলল, তোমাদের কোনো উকিল আছে কি না। বললাম, আমাদের গুম অবস্থায় সরাসরি ওখানে নিয়ে গেছে। কেমনে উকিল ধরব, উকিল নাই। তো জজ সাহেব চার দিনের রিমান্ড দিয়ে দিলেন।’
বিচারকদের যোগসাজশ বা নীরবতা: একাধিক ভুক্তভোগীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করার ন্যূনতম আইনগত দায়িত্ব পালন করেননি। ভুক্তভোগীরা জানান, নির্যাতনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতেন, যেখানে তাদের মুক্তভাবে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হতো না। এরপরই তাদের কারাগারে পাঠানো হতো। কিছু ক্ষেত্রে, ম্যাজিস্ট্রেটরা উদাসীন বা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে, কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই কেবল স্বীকারোক্তিগুলো অনুমোদন করতেন। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছে, জবানবন্দির নথিতে যা লেখা ছিল, তা তাদের কথার সঙ্গে কোনো মিল ছিল না। এটি শুধু জোর করে নেওয়া হতো, তা নয়, গরমিলও করার প্রমাণ দেয়।
জবানবন্দি নেওয়ার সময় মাহমুদুল হাসান নামের এক ম্যাজিস্ট্রেটের আচরণ কেমন ছিল, তা জানিয়েছেন একজন গুমের শিকার ভুক্তভোগী। তিনি কমিশনকে বলেন, ‘আমি বললাম, স্যার, আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। উনাদেরকে (পুলিশ) আপনি বের করেন রুম থেকে। এ সময় মাহমুদুল হাসান বলছেন, উনারা বের হবে না, যা বলার এখানে বল। আমি বলছি, স্যার, আমাকে উনারা গুম রাখছে। আমার বাবা-মা জানে না আজ পর্যন্ত আমি বেঁচে আছি কি মরে গেছি।... কিন্তু কোনোভাবেই উনাকে (ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান) ম্যানেজ করতে পারলাম না। তিনি নিজে একটি কাগজ লিখে আমাকে উনি স্বাক্ষর করতে বললেন। আমি আপত্তি জানালে তিনি বলেন, তোমার তো এত জায়গা-জমি নাই যে আমি লিখে নিয়ে যাব। সাইন করতে বলছি, সাইন কর।’
কমিশনের সুপারিশ: সরকারকে দেওয়া প্রতিবেদনে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন দুটি সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা দুটি সুপারিশ করেছি। একটি ফরোয়ার্ড থিংকিং, অপরটি পাস্ট ওরিয়েন্টেড। পাস্ট ওরিয়েন্টেড বিষয়টি হলো হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে প্রচুর ভুয়া মামলা আছে। এতে তাদের অনেক আর্থিক ক্ষতিও হয়। আমরা প্রতিবেদনে বলেছি, এসব মিথ্যা বা ভুয়া মামলা ফেস করতে একজন ভুক্তভোগীকে গড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। আমাদের দেশের হাউসহোল্ড ইনকামের ডাবল চলে যাচ্ছে একটি মামলার পেছনে। এটা পিওর অত্যাচার।’
তিনি বলেন, ‘আইনে আছে এসব মামলা এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। না হলে কী হবে সেটা নেই। আমরা বলেছি, এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে কী হবে এটার জবাব থাকা উচিত। আর ভবিষ্যতের কথা আমরা বলেছি, অবশ্যই বাংলাদেশে চরমপন্থি চিন্তাভাবনা আছে। এটা লুকোনোর কিছু নেই; কিন্তু চরমপন্থি চিন্তার সঙ্গে কীভাবে আপনি ডিল করবেন, তা ঠিক করতে হবে। বন্দুক দিয়ে যদি মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন, তাহলে এটা কঠিন। যারা স্বৈরশাসক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, তারা এটাকে অপব্যবহার করতে পারবে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চরমপন্থি ট্যাগ দিয়ে বন্দুক তাক করে বসে থাকে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যেটা বেশি করা হয়েছে।’
মন্তব্য করুন