৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনের বিষয়ে আস্থা ভোট ও অর্থ বিল ছাড়া সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন বলে দলগুলো একমত হয়েছে। এ ছাড়া সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা একশতে উন্নীত করার বিষয়ে তারা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকে এসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে।
রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। মধ্যাহ্নবিরতি দিয়ে দিনব্যাপী এ বৈঠকে বিএনপি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপিসহ জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের প্রায় সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। তবে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ বিষয়ক লন্ডন বৈঠকের জের ধরে জামায়াতে ইসলামী গতকালের এই বৈঠক বর্জন করেছে। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আশা প্রকাশ করেছেন, জামায়াতে ইসলামী আজকের বৈঠকে অংশ নেবে। অন্যদিকে জাতীয় সংসদ সম্পর্কিত চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর বাইরে বিরোধী দলগুলোর সংসদ সদস্যের সংখ্যানুপাতে অন্য জনগুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোতে সভাপতির পদ দেওয়া হবে। কমিটিগুলো হলো—পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, এস্টিমেটস কমিটি ও পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি।
দুপুর পৌনে ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৈঠকে দলগুলো তাদের মতামত তুলে ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে একমত পোষণ করে। গতকালের বৈঠকে সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ, স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন, নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে দুটি দল ছাড়া অন্যরা বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে একমত হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আবারও এ বিষয়ে আলোচনা হবে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের অধীন অর্থ বিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতার বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে বলে জানান ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি। সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে ১০০টি স্থায়ী আসন নির্ধারণের বিষয়েও ঐকমত্য গঠনের কথা তুলে ধরে আলী রিয়াজ বলেন, কোন পদ্ধতি ও কাঠামোতে নারী প্রতিনিধিত্ব থাকবে, সেটা পরবর্তী সময়ে আলোচনা হবে। আমরা আশা করছি, আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে নীতিগতভাবে কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, দলগুলো মনে করছে, এ বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করার দরকার আছে। আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক। জুলাইয়ের মধ্যে আমরা জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারব।
প্রধান বিচারপ্রতি নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদের পাশাপাশি ৪৮(৩) সংশোধন অনুযায়ী এক ধরনের ঐক্যমত্য হয়েছে। দুটি দল ছাড়া এই বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। এই বিষয়ে আগামী সপ্তাহে আবারও আলোচনা করব।
আলোচনায় জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব না থাকা প্রসঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আমরা আশা করছি, তারা আগামীকাল (আজ) অংশ নেবেন।
ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমকে দুটি রাজনৈতিক দল পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করছে। এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক দল এমন অভিযোগ করতে পারে। তবে আমরা নিরপেক্ষতার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে আমাদের প্রস্তাবের বাইরে বহু প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি। নীতিগতভাবে একমত হয়েছি, আংশিকভাবে একমত হয়েছি। জুডিশিয়ালি, ম্যাজিস্ট্রেসি, দুদকের ক্ষেত্রে এবং আরও অন্যান্য ক্ষেত্রে একমত হয়েছি। যেমন নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বহু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি, যেগুলো আমাদের প্রস্তাবের বাইরে ছিল।
বৈঠকের পর গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ১৭ জুন একটা ঐতিহাসিক দিন হয়ে থাকবে। কারণ, সংবিধানের ৭০ ধারা সংশোধন করে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন গণতান্ত্রিক মতামত দেওয়ার ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা ন্যূনতম অনেকগুলো বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছি।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ঐকমত্য কমিশন কিংবা সরকারের ভূমিকা কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটু পক্ষপাতদুষ্ট হচ্ছে কিংবা কোনো কোনো দলের প্রতি বিশেষ একটা প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এটা হলে এ সংস্কার কিংবা এই সময়ের সর্বজনীন বিষয়টা হারিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এখনো তো নির্বাচন হয়নি, কাজেই ভোট ছাড়া কোন দল বড়, কোন দল ছোট, সেটা তো আপনি নির্ধারণ করতে পারেন না। সরকার যদি আগেই কোনো কোনো পার্টির প্রতি একটা দৃষ্টিভঙ্গি রাখে, এই পার্টি বড়, এই পার্টি মেজরিটি, তাহলে তো অনেক ক্ষেত্রেই অনেকের কথার গুরুত্ব থাকে না।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আতাউর রহমান বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থ বিল ও আস্থা ভোট ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন মতামত প্রদান করার ব্যাপারে ইসলামী আন্দোলন সমর্থন করেছে। এর ওপরে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় ঐকমত্য এবং জুলাই সনদ আমাদের চূড়ান্ত করতে হলে অবশ্যই এই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, অন্যান্য স্টেকহোল্ডার, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন শহীদ পরিবারের সদস্যদের মতামতও সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
তিনি বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে যে জুলাই সনদটি হবে, সেই সনদের সুরক্ষার জন্য এবং সনদ বাস্তবায়নের জন্য সামনে গণপরিষদ কিংবা গণভোটের কোনো বিকল্প নেই। তবে ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনীম জারা বলেন, ঐকমত্য কমিশনে ৭০ অনুচ্ছেদ, স্থায়ী কমিটি, নারী আসন, উচ্চ কক্ষ এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এনসিপির নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল, এটা আমরা বাতিল চাই। তবে ঐকমত্যের স্বার্থে যেগুলোর ব্যতিক্রমে আমরা একমত হয়েছি, সেটা হচ্ছে অর্থ বিল ও আস্থা ভোট। বিএনপির পক্ষ থেকে আরও দুটি প্রস্তাব ছিল সংবিধান সংশোধনী ও যুদ্ধাবস্থা। এ ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিমত আছে, বিশেষ করে সংবিধান সংশোধনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেখানে আমাদের যারা সংসদ সদস্যরা থাকবেন, তারা যাতে ফ্রিলি এ ব্যাপারে মতামত দিতে পারেন, ভোট দিতে পারেন, সে সুযোগটা থাকা উচিত।
বিএনপিকে গুরুত্ব দেওয়ায় বৈঠকে যায়নি জামায়াত:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা বৈঠকে গতকাল অংশ না নেওয়া প্রসঙ্গে জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় তারা বৈঠকে অংশ নেয়নি। তবে আজ বুধবার অনুষ্ঠেয় বৈঠকে অংশ নেবে দলটি। জানতে চাইলে গতকাল রাতে কালবেলাকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, তারা বুধবারের বৈঠকে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করছেন।
এর আগে বৈঠকে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অংশ নিচ্ছি না। এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।
জামায়াত নিয়ে প্রেস সচিব: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আজকের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী যোগ দেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আমরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। জুলাই আন্দোলনে যারা অংশীদার, আমরা সবার জন্য সমানভাবে কাজ করছি। জামায়াতের সঙ্গে কথা হয়েছে। আশা করছি তারা আগামীকাল (আজ) বৈঠকে আসবে।
সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমে পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, আমরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছি। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব আমাদের কাছে সমান। আমরা মনে করছি, ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখছে। সংস্কার বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্য করুন