দীর্ঘ আলোচনা, ধাপে ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠক শেষে পাল্টা শুল্ক কমিয়ে আনলেও বিষয়টি নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে চলছে নানা আলোচনা। দরকষাকষির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত পাল্টা শুল্ক কমিয়ে এনে রপ্তানি খাতের ধাক্কা আপাতত সামাল দেওয়া গেলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। আর আগামীতে এ ধরনের ধাক্কা সামাল দিতে একক বাজার থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কী কী শর্ত মেনে পাওয়া গেছে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য দেশের চেয়ে কম শুল্কের এই সুবিধা, তা নিয়েও চলছে বিস্তর আলোচনা। তবে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর তাদের অনুমতিসাপেক্ষে সব প্রকাশ করা হবে। এক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে চুক্তি করা হচ্ছে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দ্বিতীয় দফার আলোচনার পর বাংলাদেশের শুল্ক যখন ৩৭ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রায় একই সময়ে ভিয়েতনামের শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়, তখনই ঢাকা দরকষাকষির জন্য জোর তৎপর হয়ে ওঠে। চূড়ান্ত প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রথম দিনই ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতামত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর দুদিন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও সচিবদের নিয়ে দীর্ঘ সভা করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কী কী পণ্য আমদানি করা যায়, তার তালিকা প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বাংলাদেশে ব্যবসারত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন ও এক্সিলারেট এনার্জির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং করে শুল্ক কমানোর জন্য বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে কোম্পানিগুলোর মতামত নেন। এ ছাড়া ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল ও আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও ভার্চুয়াল বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে ৭ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বাজারদরের চেয়ে কিছুটা বাড়তি দামে দেশটি থেকে ২ দশমিক ২০ লাখ টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনা, স্পট মার্কেটে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এলএনজি আমদানি, সরকারিভাবে তুলা আমদানি করে বাংলাদেশের ওয়্যারহাউসে রেখে দেশের আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুযায়ী মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় দেওয়ার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অধিক পরিমাণ সয়াবিন ও তুলা আমদানির উদ্যোগও নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারি প্রতিনিধিদল যখন ইউএসটিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা করে, তখন বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদল সেখানকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে সয়াবিন ও তুলা আমদানির চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডাল আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাবও দিয়েছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্যাকেজ প্রস্তাবে আরও কিছু আছে কি না, তা অবশ্য এখনো জানা যায়নি। তবে শেষ সময়ে সরকারের এসব পদক্ষেপে কিছুটা স্বস্তি এসেছে দেশের রপ্তানি খাতে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানি খাতে পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ধাক্কা এলে তা সামাল দেওয়ার পথ এখন থেকেই খুঁজতে হবে। এ ক্ষেত্রে একক বাজার নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ তাদের। জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘একদিকে সাফল্য এসেছে আমাদের। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উদ্যোগে তারা ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশকে। সামনের দিনে হয়তো এ সুযোগ আর থাকবে না। বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রম পরিবেশ ও স্বচ্ছতা আনার যেসব শর্ত দিয়েছে, তা কিন্তু ভবিষ্যতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’
শুল্ক কমানোয় ব্যবসায়ীরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তারা। গতকাল শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘আমাদের আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নির্বাহী আদেশে স্পষ্ট বলা আছে, কিছু দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বা নিরাপত্তা চুক্তি আলোচনা এখনো চলমান রয়েছে। চুক্তিগুলো হয়ে গেলে এসব দেশের পণ্যে শুল্ক আরও কমে যেতে পারে। তাই বাংলাদেশকে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।’
টানা তিন মাসের দরকষাকষির পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়া ১৯ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। তবে চুক্তির শর্ত নিয়ে আলোচনা ওঠার পর বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় যে গোপনীয়তার বিষয়টি ছিল, চুক্তি সই হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিসাপেক্ষে তা প্রকাশ করা হবে। এ ছাড়া চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর শিগগির হয়তো যৌথ বিবৃতি আসবে। তথ্য অধিকারের আলোকে এটা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজার সঙ্গে আলাপচারিতায় বাণিজ্য উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। গোলাম মোর্তোজা তার ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ফেসবুকে পেজে এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেছেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, বাণিজ্য চুক্তি কাজে লাগাতে হলে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে এ নিয়ে আত্মসন্তুষ্টির সুযোগ নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে আনতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। চূড়ান্ত দফার আলোচনার সময় বেসরকারি খাতের চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩০ মিলিয়ন ডলারের সয়াবিন আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশি আমদানিকারকরা ৩০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের মার্কিন তুলা আমদানির চুক্তি করেছেন।
মন্তব্য করুন