ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে চারটি জরিপ প্রকাশ করেছে চারটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দুটিতে এগিয়ে রয়েছে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল, একটিতে ছাত্রদল এবং অন্যটিতে এগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তবে এসব জরিপকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, তাদের কাছে আসল মাপকাঠি হলো প্রার্থীর যোগ্যতা ও দক্ষতা, কোনো প্যানেল নয়।
গত শুক্রবার সোচ্চার নামের একটি সংগঠন সর্বপ্রথম একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। অনলাইনে গুগল ফরমের মাধ্যমে গত ১ থেকে ২০ আগস্ট ৯৯১ জনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপটিতে শুধু ভিপি পদে কোন সংগঠনের প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা তুলে ধরা হয়। জরিপে বলা হয়, শিবিরের প্রার্থী সাদিক কায়েমের প্রতি সমর্থন রয়েছে ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থীর। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি সমর্থন রয়েছে ২২ শতাংশের। ছাত্রদলের প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের প্রতি সমর্থন রয়েছে ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর। ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তাদের কোনো মতামত নেই। বাকি ৫ শতাংশের বিষয়ে সোচ্চারের করা জরিপের সারসংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
পরদিন শনিবার ন্যারেটিভ নামের আরেকটি প্ল্যাটফর্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফল প্রকাশ করে। তারা ৫২৬ শিক্ষার্থীর ওপর জরিপটি করেছে। জরিপে প্রশ্ন ছিল ডাকসু নির্বাচনের শুধু তিন শীর্ষ পদ—সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) নিয়ে। জরিপে ১৪টি হলের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে তথ্য নেওয়া হয়। প্রতিটি হল থেকে তথ্য নেওয়া হয় গড়ে ৩৮ জনের কাছ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংখ্যা ১৯। ছাত্রদের ১৪টি আর ছাত্রীদের ৫টি। জরিপে ছেলেদের ১০টি ও মেয়েদের ৪টি তথ্য থেকে নমুনা নেওয়া হয়েছে। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া হয়নি।
জরিপের ফল অনুযায়ী, ভিপি পদে এগিয়ে রয়েছেন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী সাদিক কায়েম। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন সাদিক কায়েম ভিপি পদে জয়ী হবেন। ছাত্রদলের প্যানেলের ভিপিপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান জয়ী হবেন বলে মনে করেন ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটার। শামীম হোসেনের পক্ষে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও উমামা ফাতেমার পক্ষে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দেন। আর ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোটার এ বিষয়ে মত জানাতে রাজি হননি। জরিপে জিএস প্রার্থীদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের এস এম ফরহাদে। ৩২ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী তাকে জিএস হিসেবে নির্বাচিত করতে চান। ছাত্রদলের তানভীর বারী হামিম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরীর পক্ষে মতামত দিয়েছেন ১৬ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর আবু বাকের মজুমদারের পক্ষে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দেন। তবে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জিএস পদে কাকে ভোট দেবেন, তা এখনো ঠিক করেননি। এজিএস পদেও এগিয়ে রয়েছেন শিবিরের প্যানেলের প্রার্থী মহিউদ্দিন খান।
এদিকে বাংলাদেশ পাবলিক একাডেমি (বিপিএ) এবং ভলানটিয়ার সংস্থা ‘বেসরকারি’ আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে ভিপি প্রার্থীদের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। এ জরিপে অংশ নিয়েছেন ২৪০ জন ইচ্ছুক ভোটার। বিপিএর জরিপ অনুযায়ী, ২৪০ ইচ্ছুক ভোটারের ভোটে বাগছাসের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের ১৮ শতাংশ, ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ৪৬ শতাংশ, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা ১২ শতাংশ এবং ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মো. আবু সাদিক কায়েম ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। বাংলাদেশ পাবলিক একাডেমি তাদের ফেসবুকে জরিপের এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
এ ছাড়া সর্বশেষ গতকাল রোববার বিকেলে জরিপের ফল প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদের সভাপতি ফাহিম হাসান মাহদি জানান, জরিপে সর্বোচ্চ ৩৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ডাকসুতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন। ভোটদানে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দেবেন বলে জানান। এর পরই রয়েছে ছাত্রশিবির। ২০ দশমিক ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী শিবিরকে ভোট দেবেন বলে মতামত দেন। ১৬ দশমিক ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী ছাত্রদল, ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য ও ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বাগছাসকে ভোট দেবেন বলে জানান।
জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ তথা ৫০৪ জন নারী শিক্ষার্থী ও ৪৪ শতাংশ তথা ৩৯৬ জন পুরুষ শিক্ষার্থী মতামত দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সর্বমোট ৪৫ শতাংশ অনাবাসিক এবং ৫৫ শতাংশ আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে জানান তিনি।
জরিপের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন
চারটি জরিপের তিনটি নিয়েই রয়েছে প্রশ্ন। এসব জরিপে দলীয় প্রভাব ও রাজনীতি রয়েছে বলে মনে করেন প্রার্থী ও বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া ভোটারদের বড় অংশকেই জরিপের বাইরে রাখা হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
জরিপকারী সংগঠন ‘সোচ্চার’-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শিবিরের প্যানেল থেকে ডাকসু নির্বাচনে সদস্য পদে অংশ নিচ্ছেন। ন্যারেটিভ নামক প্রতিষ্ঠানেরও শিবির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ করেন অন্যান্য প্রার্থী। এ ছাড়া ‘বাংলাদেশ পাবলিক একাডেমি’ (বিপিএ) কর্তৃক জরিপটির নিরপেক্ষতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
জরিপের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ন্যারেটিভের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ রুহেল বলেন, তারা সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থেকে জরিপ করার চেষ্টা করেছেন। কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে জরিপ করা হয়নি।
‘সোচ্চার’-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আনাস বিন মুনির। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্যানেল থেকে এবারের ডাকসু নির্বাচনে সদস্য পদে প্রার্থী হয়েছেন। যদিও আনাস বিন মুনির বলেন, জরিপটি করেছে সোচ্চারের বাংলাদেশ শাখা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। জরিপের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই।
গবেষণা সংসদের সভাপতি ফাহিম হাসান মাহদি জানান, ‘প্যানেল ঘোষণা-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, মনোভাব ও প্রত্যাশা বোঝাই ছিল এ জরিপের মূল লক্ষ্য। আমাদের জরিপ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার জায়গা থেকে করা হয়েছে।’
যা বলছেন প্রার্থীরা
জরিপের বিষয়ে ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান কালবেলাকে বলেন, আমরা দেখেছি কয়েকটা জরিপ প্রকাশ করা হয়েছে। আমি মনে করি, এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আশা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসবে প্রভাবিত হবেন না। তারা যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন।
শিবিরের প্যানেলের এজিএস প্রার্থী মহিউদ্দীন খান বলেন, দুটি জরিপ শিবিরের দ্বারা প্রভাবিত বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। এসবের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। আমরা জরিপে নয়, ভোটারদের ভোটে বিশ্বাস রাখতে চাই।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের কালবেলাকে বলেন, জরিপের গুরুত্ব আছে, তবে এসব জরিপের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বেশিরভাগই জরিপ নিছক রাজনৈতিকভাবে করা হয়। আমি মনে করি ভোটাররা এখনো অনেকেই সিদ্ধান্তই নেননি কাকে ভোট দেবেন। যোগ্যতা, দক্ষতা বিবেচনা করেই তারা প্রার্থী বেছে নেবেন।
জরিপগুলোতে অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা বাইরেই রয়ে গেছেন। তাদের উদ্দেশে ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আপনারা যাকে খুশি তাকে ভোট দিন, তবে দয়া করে ৯ তারিখে ভোট দিতে আসুন। আপনাদের ভোটে গোটা সমীকরণ বদলে যাবে। এখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা একটি পদেও জয়ী হতে পারবে না। শুধু উপস্থিতি নিশ্চিত করুন, ভোটটা দিয়ে যান।’
যা বলছেন শিক্ষার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার কালবেলাকে বলেন, দেখেছি কয়েকটি জরিপ হয়েছে, তবে আমি একটাতেও অংশ নিইনি। ব্যক্তিগতভাবে এখনো প্রার্থীদের যোগ্যতা, দক্ষতা দেখে মূল্যায়ন করছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নিতে পারিনি। কে কোন প্যানেল এসব দেখে নয়, প্রার্থীর সার্বিক দিক দেখেই ভোট দেব।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তামান্না খানম বলেন, আমি একজন অনাবাসিক শিক্ষার্থী। যারা নির্বাচনে প্রার্থিতা করছেন, তাদের খুব বেশি চেনাজানা নেই। তাদের জানার, বোঝার চেষ্টা করছি। যাদের যোগ্য মনে হবে, যাদের কাজের স্প্রিট ভালো এবং অতীতে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ভূমিকা রেখেছে, তাদেরই বেছে নেব।
রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার বলেন, প্রতিটি পদে কাকে ভোট দেব সেটা লিস্ট করছি। প্রার্থীর কী কাজ আছে, ইশতেহারে কী আছে, অতীতে কী করেছে—সবকিছু দেখেই চূড়ান্ত করছি। এখনো সব পদে চূড়ান্ত করতে পারিনি। আমি মনে করি কোনো প্যানেল দেখে ভোট দেওয়া উচিত নয়। প্রতিটি প্যানেল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে কেউ না কেউ যোগ্য আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, একটি জরিপে শিক্ষার্থীদের কোনো অংশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কোনো অংশকে হয়নি। এর যুক্তি কী, সেটা স্পষ্ট নয়। দৈবচয়নের ভিত্তিতে সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হলে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতো। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে ভোটারদের মনোজগতকে প্রভাবিত করার জন্য এ ধরনের জরিপ করা হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক।
মন্তব্য করুন