কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:০৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে ডাকসু

ছাত্ররাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ
ডাকসু ভবন। ছবি : সংগৃহীত
ডাকসু ভবন। ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর হওয়া এবারের নির্বাচন ঘিরে দেশের ছাত্ররাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উচ্ছ্বাস, বিপুলসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি এবং দিনভর অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে ভোট গ্রহণ হওয়া এই নির্বাচনের প্রভাব শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এর ফল জাতীয় রাজনীতিতে, বিশেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। ঐতিহ্যগতভাবে এখান থেকেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন তাদের নেতৃত্ব তৈরি করে এসেছে। ফলে ডাকসু নির্বাচনে যে ছাত্র সংগঠন জয়ী হয়, তা সেই ছাত্র সংগঠনের মূল দলের জনপ্রিয়তা ও জনভিত্তির একটি প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের ডাকসু নির্বাচনের ফলও বিজয়ী প্রার্থীর মূল দলকে আগামী সংসদ নির্বাচনে খানিকটা এগিয়ে রাখতে পারে।

মিনি পার্লামেন্ট-খ্যাত ডাকসু ও হল সংসদের গতকালের নির্বাচনের ফল রাত পৌনে ২টা থেকে আবাসিক হলগুলোতে পৃথকভাবে ঘোষণা করা শুরু হয়। ভোর ৪টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত পাঁচটি কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ডাকসুর ২৮টি পদের মধ্যে অধিকাংশ পদে এগিয়ে ছিলেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীরা। হল সংসদের ফলেও দেখা যায় একই ধারা। আর এমন ফলের প্রভাব শুধু ঢাবি ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে এর প্রতিফলন ঘটবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এবারের ডাকসু নির্বাচন অনেকে দেখছেন নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক রুচি ও প্রবণতা যাচাইয়ের একটি সুযোগ হিসেবে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে কোন আদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে, তা এই নির্বাচনের মাধ্যমে স্পষ্ট হবে। যেহেতু আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের সংখ্যা ৩ কোটির বেশি, তাই ডাকসুর ফল রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সেজন্য এ নির্বাচনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছে বড় দলগুলো। এমন প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচন যতটা না ছাত্ররাজনীতির, তার চেয়ে বেশি জাতীয় রাজনীতির একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে। এই নির্বাচনের ফল শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নয়, দেশের রাজনীতি এবং জাতীয় নির্বাচনের গতিপথও নির্ধারণ করতে পারে।

ডাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর প্রচার ঘিরে সৃষ্ট উন্মাদনা শুধু ঢাবি ক্যাম্পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

সর্বমোট ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন শিক্ষার্থীর ভোটাধিকারের এ নির্বাচন ঘিরে গ্রামগঞ্জের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যন্ত আলাপ-আলোচনায় ছিল ডাকসু। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোও প্রতিদিনই সংবাদ শিরোনামে রেখেছে এ নির্বাচন। ভোটের আগের দিন থেকে শুরু করে ফল ঘোষণার মুহূর্ত পর্যন্ত সার্বক্ষণিক নজর ছিল শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের।

গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা নেয় নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর কেটে গেছে এক বছরেরও বেশি সময়। তবে এ সময়ে বলার মতো কোনো বড় প্রতিষ্ঠান কিংবা স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সারা দেশের মানুষের কাছে ছিল বিশেষ গুরুত্বের। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে কারচুপি, জোরজবরদস্তি ও দলীয় প্রভাবের অভিযোগে শিক্ষার্থীরা যে হতাশায় ভুগছিল, এবার তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে অনেকটাই। ভোর থেকেই ক্যাম্পাসে ভোটকেন্দ্রগুলোর সামনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন লক্ষ করা যায়। আবাসিক হল থেকে শুরু করে অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাও দলবেঁধে ভোট দিতে আসেন। শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, উদয়ন স্কুল কিংবা কার্জন হল—প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল উপচে পড়া।

শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, এ নির্বাচন ছিল ‘প্রহসনের জবাব’। দীর্ঘদিন পর স্বাধীন ও তুলনামূলক নিরপেক্ষ পরিবেশে ভোট দিতে পারার আনন্দ তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট ছিল। ভোট দেওয়া মানে যে উৎসব, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যা একসময় ছিল সাধারণ চিত্র, এবার তার প্রতিফলন দেখা গেছে ডাকসু নির্বাচনের ময়দানে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেকই নারী শিক্ষার্থী। এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নজর কেড়েছে সবার। ভোট গ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোতে বিপুলসংখ্যক নারী শিক্ষার্থীকে ভোট দিতে দেখা গেছে। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের হিসাবে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল সমানতালে।

নারী ভোটারদের ভাষ্য, নিরাপদ পরিবেশে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে পারাটা ছিল তাদের বড় একটি অভিজ্ঞতা। তাদের মতে, ২০১৯ সালের ভোটের মতো ভয়ভীতি এবার ছিল না। প্রত্যেকেই নিজেদের মতামত প্রকাশে স্বাধীন ছিলেন। ফলে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ শুধু পরিসংখ্যানে নয়, প্রতীকী দিক থেকেও গুরুত্ব বহন করছে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদেরও ভোট প্রদানে উৎসাহ দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস এবং অনেকে নানা যানবাহনে করে ক্যাম্পাসে ভোট দিতে আসেন। ফলে ভোট গ্রহণের হারও বেড়েছে।

ডাকসু নির্বাচনে এবার যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো রেকর্ডসংখ্যক ভোট প্রদান। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কার্জন হলে পড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে ৮৩ শতাংশ, উদয়ন স্কুল কেন্দ্রে ৮৫ শতাংশ এবং অন্যান্য কেন্দ্রেও ভোট পড়েছে ৭০ শতাংশের ওপরে। এ পরিসংখ্যান শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নয়, দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনী বাস্তবতায়ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

এই ভোটের হার প্রমাণ করে, শিক্ষার্থীরা যদি আস্থা পায় এবং সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছতে পারে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, ডাকসু নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির জন্য এক ইতিবাচক বার্তা হয়ে এসেছে।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল, প্রচারের সময় থেকে ভোট গ্রহণের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের সহিংসতা বা কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটেনি। যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, তবে তা নির্বাচনের সামগ্রিক চিত্রে প্রভাব ফেলেনি। প্রার্থীরা অভিযোগ তুললেও ভোটারদের কাছে নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ডাকসু নির্বাচনে এই ইতিবাচক অভিজ্ঞতা সারা দেশের মানুষের নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।

নির্বাচন ঘিরে অন্যরকম এক ক্যাম্পাস দেখেছেন পড়ুয়ারা। পুরো ক্যাম্পাসে ছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। সোমবার রাত থেকেই ক্যাম্পাসে প্রবেশের ক্ষেত্রে ছিল কড়াকড়ি। ভোট গ্রহণ সামনে রেখে ওইদিন রাত থেকেই পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। সাধারণ শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়ান ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে। ভোর পর্যন্ত টিএসসি, রাজু ভাস্কর্য, ভিসি চত্বর, মল চত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে শিক্ষার্থীর ভিড়। ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশপথে ছিল কড়াকড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং অনুমতিপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট সাংবাদিকদের বাইরে কেউ-ই ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেননি। আটটি প্রবেশপথে বসানো ছিল নিরাপত্তা চৌকি। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি ছিল মোবাইল প্যাট্রল, ডগ স্কোয়াড, বিশেষায়িত টিম, বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াত টিম, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা (ডিবি), সিসিটিভি মনিটরিং সেল এবং স্ট্রাইকিং রিজার্ভ ফোর্স।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডাকসুর ২৮ পদে কারা কোনটিতে জয়ী, একনজরে দেখে নিন

ইসরায়েলের দুই মন্ত্রীকে নিষেধাজ্ঞা দিল স্পেন

‘আইটেম সং’-এ পারফর্ম করতে চান শার্লিন

সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে বিজয়ী কে এই তামান্না

কার সঙ্গে কার বিয়ে হবে এটা কি পূর্বনির্ধারিত, নাকি কর্মের ফল?

কাতারও জানত ইসরায়েল হামলা করবে, দাবি যুক্তরাষ্ট্রের

চীন-ভারতের ওপর এবার ১০০ শতাংশ শুল্ক বসাতে বললেন ট্রাম্প 

শেখ হাসিনার পূবালী ব্যাংকের লকার জব্দ

মসজিদের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল এখন গলার কাঁটা

আমি বরাবরই খুব ইমোশনাল: শ্রাবন্তী

১০

ডাকসুতে কে কত ভোট পেলেন?

১১

বাছাইপর্বে বিশ্বরেকর্ড ছুঁলেন রোনালদো

১২

শীর্ষ চাল ব্যবসায়ী রশিদ গ্রেপ্তার

১৩

প্লট দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার 

১৪

হলান্ডের পাঁচ গোলে নরওয়ের ১১ গোলের ধ্বংসযজ্ঞ

১৫

স্ত্রীর সামনে ১৭ মামলার আসামিকে গলা কেটে হত্যা

১৬

ডাকসু নির্বাচনে বিজয় উপলক্ষে ছাত্রশিবিরের কর্মসূচি ঘোষণা

১৭

কাতারে ইসরায়েলি বিমান হামলার তীব্র নিন্দা জানাল পাকিস্তান

১৮

কেমন ছিল জিৎ-কোয়েলের সম্পর্ক?

১৯

বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্রাজিলের লজ্জার রেকর্ড

২০
X