

বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পটি ভারতীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নের কথা ছিল; কিন্তু প্রকল্পের অর্থায়নে দুর্গতি ও কাজে গতি না থাকায় সেখান থেকে সরে আসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যদিও এই প্রকল্পসহ রেলের মোট তিনটি প্রকল্পে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয় ভারত। এরপর নতুন অর্থায়নের খোঁজ শুরু হয়, যার ধারাবাহিকতায় এখন বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের অর্থায়নে আসছে চীন। অবশ্য এসবের মাঝে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশকে খেসারত দিতে হবে অন্তত ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত।
ভারতীয় অর্থায়ন থেকে সরে আসার পর এখন এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে অর্থ নেওয়া হচ্ছে। ২০১৫ সালে এশিয়ার উন্নয়নের জন্য চীনের উদ্যোগে ব্যাংকটির যাত্রা শুরু, যার প্রধান কার্যালয় চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে। পুরোনো প্রকল্পে নতুন অর্থায়ন, মাঝে চলে গেছে সাত বছর। নতুন চুক্তির পর কাজ শুরু করতে অন্তত আরও এক বছর সময় লাগবে। পুরোনো বিশদ নকশা (ডিটেইলড ডিজাইন) ও সম্ভাব্যতা যাচাই মেনে নিয়েই ঋণ দেবে এআইআইবি। ফলে নির্মাণকাজ শুরুর আগে নতুন করে এই দুই কাজ আর করতে হবে না।
তবে খরচ বাড়ার কারণে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করতে হবে। সেই কাজ এখন চলমান। সংশোধিত ডিপিপিতে নতুন নির্মাণ ব্যয় চূড়ান্ত হবে। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি যখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করা হয়, তখন সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এখন এই ব্যয় গিয়ে সাড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আফজাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘প্রকল্পটি আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই লোন (ঋণ) এগ্রিমেন্টে আমাদের দিক থেকে এনওসি (সম্মতিপত্র) দেওয়া হয়েছে। এখন ইআরডি ঋণ চুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। আর যে ব্যয়টা বর্তমানে আছে সেটি ডিটেইলড ডিজাইনের আগে সম্ভাব্য হিসেবে ধরা হয়েছিল। ডিপিপি সংশোধন হচ্ছে। নতুন ব্যয় এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে যতটুকু শুনেছি ব্যয় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়বে।’
যদিও প্রকল্প দপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তে পারে। দপ্তরটির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘টাকার বিপরীতে ডলারের মান বৃদ্ধি এবং নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণেই তো ৫০-৬০ শতাংশ ব্যয় বেড়ে যাবে। আর ২০১৭ সালে যখন প্রাথমিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, সেটি ছিল ধারণামূলক ব্যয়। মাঝে ৭-৮ বছর চলে গেছে। এখন ডিটেইলড ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত ব্যয় নির্ধারণ করা হচ্ছে। বাফারও (নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বাড়তে পারে ধরে নিয়ে অতিরিক্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমন্বয়) রাখা দরকার। সব মিলিয়ে ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়বে।’
এলওসিমুক্ত বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ: বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে শুরু হয়েছিল রেল সম্প্রসারণের একটি আশাব্যঞ্জক যাত্রা—‘লাইন অব ক্রেডিটে’র (এলওসি) আওতায়। তিনটি বৃহৎ চুক্তির ভিত্তিতে বাস্তবায়নের কথা ছিল মোট আটটি অবকাঠামো প্রকল্প, যার ছয়টিই ছিল রেল খাতে; কিন্তু ২০২৪ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ভারতে কৌশলগত অগ্রাধিকার পুনর্মূল্যায়নের জেরে এই কর্মসূচির গতি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ভারত সরকার বাংলাদেশে রেলের তিনটি প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে দুটি প্রকল্প একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সে দুটি হলো রংপুরের কাউনিয়া থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত মিটার গেজ লাইনকে ডুয়েল গেজ লাইনে রূপান্তর প্রকল্প এবং খুলনা থেকে দর্শনা পর্যন্ত নতুন ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প।
এআইআইবির অর্থায়নে সম্মতি: বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ প্রকল্পে এআইআইবি অর্থায়ন করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে রেলওয়ের কাছে মতামত জানতে চেয়ে ইআরডি একটি চিঠি দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ আগস্ট রেলওয়ের ডিজি মো. আফজাল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে এআইআইবির ঋণ নেওয়ার বিষয়ে রেলওয়ে সম্মতি জানায়। সেই চিঠিতে বলা হয়, ‘এআইআইবি থেকে একটি চিঠি পাওয়া গেছে। সেই চিঠির মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ রেলওয়ের বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত নতুন ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, গত ৫ মার্চ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সভায় এ প্রকল্পটি এলওসি তালিকাভুক্ত থেকে সরিয়ে আনার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট থেকে বিবেচ্য প্রকল্পটি বাদ দেওয়ার বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘এই প্রকল্পটি বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি বৃহৎ ও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা হয়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের স্বল্পতম দূরত্বের যোগাযোগ স্থাপন হবে। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের মাঝে রেল দূরত্ব বর্তমানের তুলনায় প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার হ্রাস পাবে। এমন অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এআইআইবির প্রস্তাবিত অর্থায়নের বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করছে। এআইআইবির অর্থায়নের বিষয়ে রেলওয়ের সম্মতি সম্পর্কিত মতামত ইআরডিকে পত্রের মাধ্যমে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।’
জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘এআইআইবি এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতে আগ্রহী। ইআরডি আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। আমরা সম্মতি জানিয়েছি। এখন ইআরডি এটা নিয়ে কাজ করছে। আমরা তো অর্থায়ন খুঁজছিলাম, আমাদের অর্থায়ন লাগবে। প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ, ফলে এআইআইবির প্রস্তাবে আমরা আগ্রহ দেখিয়েছি।’
বারবার হোঁচট: প্রথমবারের মতো ২০১০ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি প্রাক-সমীক্ষা করা হয়। যদিও অর্থ সংকটের কারণে দীর্ঘদিন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ গতি পায়নি। ২০১৭ সালে ভারতের এলওসি অর্থায়নে রেলপথটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষের পরিকল্পনা ছিল। এখন এই প্রকল্পের সমাপ্তি মোটামুটি ২০৩০ সাল ছুঁবে। যদিও ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের সর্বশেষ মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সাল করা হয়েছে।
প্রকল্পের নথির তথ্য বলছে, প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতের ঋণ দেওয়ার কথা ছিল ৩ হাজার ১৪৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা; কিন্তু ভারত শেষ পর্যন্ত কোনো ঋণ ছাড় করেনি। সর্বশেষ গেল অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের মোট ভৌত কাজ হয়েছে ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। যা করতে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৯৪৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ছিল ১ হাজার ৯২৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক নথিতে বলা হয়েছে, “প্রকল্পটিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অর্থায়নে অনাগ্রহ প্রকাশ করায় এটি এলওসি থেকে ‘ডি-লিস্টিং’-এর বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর পরামর্শক সেবা কার্যক্রম অবসানের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে ‘টারমিনেশন অব কন্ট্রাক্ট ফর কনভিনিয়েন্স’ নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর বিকল্প অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিকল্পনা বিভাগে গত ১০ অক্টোবর পিডিপিপি পাঠানো হয়।”
অনুমোদনের ৮ বছরে জমি অধিগ্রহণের অর্থ ছাড়: প্রকল্প অনুমোদনের আট বছরের মাথায় এসে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ১৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ মোট ১ হাজার ৯২০ কোটি ১০ লাখ ছাড় করেছে। গত ২৪ জুন ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ বগুড়ার জেলা প্রশাসককে ৯৬০ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসককে ৯৬০ কোটি টাকার চেক দেওয়া হয়।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে ঢাকার সঙ্গে বগুড়ার রেলপথে দূরত্ব কমবে প্রায় ১১২ কিলোমিটার। সেইসঙ্গে বগুড়া-ঢাকা যাতায়াতে সময় বাঁচবে তিন ঘণ্টা। পুরো রেলপথে ৮৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার মূল লাইনের সঙ্গে ৩৭ দশমিক ৪৯ কিলমিটার লুপ লাইন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় রেলপথে করতোয়া ও ইছামতী নদীতে দুটি বড় সেতু নির্মাণ করা হবে। আর ছোট-বড় মিলিয়ে মূল ২৫টি রেলসেতু থাকবে। আর ৯১টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, একটি সড়ক ওভার পাস, একটি রেল উড়ালপথ এবং একটি সড়ক আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে।
নতুন এই রেলপথ সিরাজগঞ্জ জংশন, কৃষ্ণদিয়া, রায়গঞ্জ, চান্দাইকোনা, ছোনকা, শেরপুর, আরিয়া বাজার এবং রাণীরহাট এলাকায় মোট আটটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে কাহালু স্টেশন পুনর্নির্মাণ হবে। আর শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন হবে সম্প্রসারণ। এ ছাড়াও নির্মাণ করা হবে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ১০৬টি লেভেল ক্রসিং গেট। ১১টি স্টেশনে কম্পিউটার বেইজড সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক শামছুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘প্রথমেই দেখতে হবে এটি কোনো অনুরোধের প্রকল্প ছিল কি না। আর ২০১৮ সালে এক ধরনের ব্যয়ে প্রকল্পটি ফিজিবল (নির্মাণের জন্য উপযুক্ত) ছিল; কিন্তু এখন দিগুণ ব্যয়ে প্রকল্পটি ফিজিবল কি না, সেটি যাচাই করে দেখা দরকার।’
মন্তব্য করুন