

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হলেও বিএনপির সঙ্গে সমমনাদের আসন বণ্টন বা সমঝোতা ইস্যুর সুরাহা হয়নি এখনো। এ নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের জোটে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা। শরিকদের জন্য কতটি আসন ছাড়া হবে, সে বিষয়ে এখন বিএনপির ‘স্পষ্ট’ অবস্থান জানতে চায় মিত্ররা। তারপর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন তারা। গত বুধবার যুগপতের শরিক ২৯টি দলের শীর্ষ নেতারা বৈঠক করে এমন সিদ্ধান্ত নেন। এ অবস্থায় বিএনপি মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার রাতে বৈঠক ডাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার অনুপস্থিতির কারণে শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি হয়নি। মুলতবি বৈঠকটি আজ শনিবার বেলা ১১টায় হওয়ার কথা রয়েছে। জানা গেছে, আলোচনায় ‘সমঝোতা হলে’ জোটের ঐক্যের স্বার্থে ঘোষিত আসনে শরিকদের জন্য প্রার্থিতায় পরিবর্তনও আনতে পারে বিএনপি। সেক্ষেত্রে ঘোষিত দু-একটি আসনে মিত্রদের জন্য সুসংবাদও আসতে পারে।
এ দিকে নির্বাচনী সমঝোতা প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সৃষ্ট দূরত্ব বা টানাপোড়েনের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছে জামায়াতে ইসলামী, যারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটির পক্ষ থেকে যুগপৎ জোটের ‘মনোনয়নবঞ্চিত’ সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত শরিকদের সমঝোতা না হলে তাদের কাছে টানতে পারে জামায়াতে ইসলামী। জানা গেছে, সেক্ষেত্রে তাদের কাউকে কাউকে দলীয় প্রার্থী করতে পারে জামায়াত।
শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমাদের কোনো সমস্যা নেই। রাজনৈতিক দল-জোটের মধ্যে তো এগুলো (বোঝাপড়ার ঘাটতি) থাকে। আমরা চূড়ান্তভাবে তো প্রার্থী তালিকা দিইনি। প্রাথমিক কথা বলেছিলাম, এখন সেটা প্রায় চূড়ান্ত। যারা আমাদের সঙ্গে যুগপৎভাবে আন্দোলন করেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে অবশ্যই তাদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হবে। আমি মনে করি, কোনো সমস্যা থাকবে না। আমরা অত্যন্ত আশাবাদী, যারা বিগত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা সবাই নির্বাচনে অংশ নিতে পারব।’
বিএনপি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ‘অত্যন্ত কঠিন’ মনে করছে। এ অবস্থায় মিত্রদের জন্য ছাড়া আসন কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না দলটি। অন্যদিকে, আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে সংশোধিত আরপিও ভাবাচ্ছে দলটিকে। আরপিও অনুযায়ী নির্বাচনে নিবন্ধিত একাধিক দল জোটভুক্ত হলেও ভোট করতে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে। তাই আগামী নির্বাচনে প্রতীক একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করছেন, এ অবস্থায় শরিক অন্য দলগুলোর প্রতীককে নির্বাচনী মাঠে পরিচিত করানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে। ধানের শীষের পক্ষে নেতাকর্মীদের যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নামানো যাবে, অন্য দলের প্রতীকের পক্ষে সেভাবে নামানো সম্ভব হবে না। তাই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী এবং আরপিও বিবেচনায় নিয়ে শুধু বিজয়ী হতে পারার মতো শরিকদেরই আসন ছাড়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। অবশ্য ‘যৌক্তিকভাবে’ জোটের ঐক্য অটুট রাখতেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দলটি। তাই মিত্রদের যাদের মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হবে না, তাদের সংসদের উচ্চকক্ষসহ ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়নের চিন্তা রয়েছে বিএনপির।
নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩ নভেম্বর প্রথম পর্যায়ে ২৩৭ আসন এবং এক মাস পর ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ৩৬ আসনে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে বিএনপি। সে হিসাবে মোট ২৭২ আসনে প্রার্থিতা ঘোষণা করা হয়েছে। এখনো ফাঁকা রয়েছে আর ২৮টি আসন। বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, এ ফাঁকা আসনগুলোতে মূলত শরিকরাই নির্বাচন করবেন।
অবশ্য জোট নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির চাওয়া অনুযায়ী দল ও জোটের প্রার্থী তালিকা জমা দিলেও তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই ২৭২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘটনায় তারা বিস্মিত, অনেকে ক্ষুব্ধও। কারণ, এর মধ্যে অন্তত ছয়টি আসনে ‘অনিবন্ধিত’ দল ও জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তারা হলেন কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে ১২ দলীয় জোটভুক্ত জাতীয় পার্টির (জাফর) মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকন, মৌলভীবাজার-২ থেকে জাতীয় পার্টির (জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য নওয়াব আলী আব্বাস খান, নড়াইল-২ থেকে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, কিশোরগঞ্জ-৫ থেকে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, ঝালকাঠি-১ থেকে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান এবং যশোর-৫ থেকে ১২ দলীয় জোটভুক্ত জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব রশিদ বিন ওয়াক্কাস। তবে তাদের কাউকে আসন ছাড়েনি বিএনপি। এদের মধ্যে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হিসেবে আহসান হাবিব লিংকন, ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ও মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট করেন। অবশ্য ইরান তখন পিরোজপুর-২ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন।
এ অবস্থায় করণীয় নির্ধারণে গত বুধবার রাজধানীর তোপখানা রোডে শিশু কল্যাণ পরিষদে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণঅধিকার পরিষদ, গণফোরাম এবং একটি ইসলামী দলসহ মোট ২৯টি দল বৈঠকে বসে। জানা গেছে, বৈঠকে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আসন সমঝোতা ইস্যুতে মিত্রদের নিয়ে কী ভাবছে, সেটা স্পষ্টভাবে বিএনপির কাছে জানতে চাওয়া হবে। তারপর তারা তাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন। বৈঠকে অধিকাংশ নেতা অভিমত দেন, উচ্চকক্ষ নয়, তারা সরাসরি নির্বাচন করে এমপি হতে চান। তারা বিএনপির কাছে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন চান, এটা কোনো দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সভায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হলেও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো কোনো চরম পদক্ষেপ এখনই নিতে চাইছে না দলগুলো। বরং তারা এ সম্পর্কের ভিত্তিতেই নিজেদের দাবিগুলো জোরালোভাবে উত্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা মনে করেন, এ মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ধরে রাখা জরুরি। তাই আপাতত ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে আনার কৌশল নিয়েছেন তারা। অবশ্য বৈঠকে এমন আলোচনাও হয় যে, বিএনপির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা না হলে প্রয়োজনে তারা নিজেরা জোটবদ্ধ হয়ে ৩০০ আসনে নির্বাচন করবেন। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ শনিবার গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর আবারও নিজেরা বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন মিত্ররা।
নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘সবচেয়ে দুর্দিন-কঠিন দিনগুলোতে যারা রাজপথে লড়াইয়ে শরিক ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে প্রধান শরিক বিএনপিকে যথাযথ বিবেচনা করতে হবে। এটা বিএনপির কোনো দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়, এটা ন্যায্যতা-মর্যাদা-প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন। লড়াইয়ের এ মানুষগুলো যাতে পার্লামেন্টেও আসতে পারেন, পার্লামেন্টে যাতে লড়াইয়ের একটা প্রতিনিধিত্ব থাকে—এটাই বিবেচনার প্রশ্ন। বিএনপি নির্বান্ধব হওয়ার যে কৌশল নিয়েছে, আশা করি, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেখান থেকে সরে আসবে এবং সবাইকে আস্থার মধ্যে নিয়ে তাদের মিত্র-বন্ধুর সংখ্যা বাড়াবে। কেননা, সামনে অনেক বড় ঝুঁকি আছে, সেখানে আমাদের ঐক্যবদ্ধতা লাগবে।’
যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে বিএনপির মুলতবি বৈঠক প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, এটা নিয়ে যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয় এবং অনেকেই আসতে না পারায় বিএনপি বৈঠকটি শনিবারে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে ৪০টির বেশি দল ২০২২ সাল থেকে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। আমরা নিপীড়ন, রিমান্ড, নির্যাতন সবকিছু সহ্য করেছি। এখন নির্বাচন সামনে, প্রতিটি দলেরই প্রত্যাশা আছে। বিএনপি এরই মধ্যে তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। শরিকরাও দলগতভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এখন মূল আলোচনা হবে—কতটি আসন শরিকদের জন্য ছাড়া হবে। এ বিষয়ে তারা সঠিক ও ন্যায্য সিদ্ধান্ত আশা করেন।
বিএনপি ২০১৮ সালে শরিকদের জন্য ৫৯টি আসন ছেড়েছিল। সে সময় জামায়াতকে ২২টি আসন ছাড়লেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচনে দলটি এবার বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই শরিকদের জন্য বিএনপির এবার আসন ছাড়ের সংখ্যাও কম হবে। জানা গেছে, সেই সংখ্যা ১৫-এর মতো হতে পারে। বিএনপির নেতৃত্বে নির্বাচনী জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররা ছাড়াও জামায়াতের বাইরে দু-একটি ইসলামী দল এ জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে।
মন্তব্য করুন