সদ্য সমাপ্ত পাঁচ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কঠোর অবস্থানে ছিল রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। দলের নেতাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে থাকার নির্দেশের পাশাপাশি ভোটারদের কেন্দ্রে না যেতে দলটির পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। দলের আদেশ মেনে নির্বাচন থেকে দূরে থাকেন মেয়র পদপ্রার্থীরা। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা কাজে আসেনি তৃণমূলে।
নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিএনপির ১১৬ জন বর্তমান ও সাবেক নেতা কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নেন। এর মধ্যে দল থেকে আজীবন বহিষ্কার হওয়া ও নানাবিধ বাধা ঠেলে জয় ছিনিয়ে আনেন ৩৪ জন। দলটির তৃণমূলের নেতা ও ভোটাররা দলীয় নির্দেশ অমান্য করেই নেমে যান ভোটের মাঠে। এ ঘটনা আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিএনপিকে ভাবিয়ে তুলেছে।
রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, স্থানীয় সরকারের সিটি করপোরেশনের ভোটে কেন্দ্রের কথা শোনেনি বিএনপির তৃণমূল, যা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির জন্য অ্যালার্মিং। কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে বিএনপি। দলটি যদি শেষ পর্যন্ত এ অবস্থানে অনড় থাকে, সেক্ষেত্রে নির্বাচনমুখী নেতাদের অনেককে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
২৫ মে গাজীপুর, ১২ জুন বরিশাল ও খুলনা এবং ২১ জুন তৃতীয় ধাপে রাজশাহী ও সিলেটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং বাকি চার সিটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা মেয়র পদে জয়ী হন।
পাঁচ সিটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কাউন্সিলর পদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পাঁচ সিটির মোট ১৯০টি ওয়ার্ডে বেশিরভাগ জয় পান ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। বিএনপির বহিষ্কৃত নেতারা জয় পান ৩৪টিতে। গাজীপুরে ৫৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪২টিতেই জয় পান ক্ষমতাসীনরা। এই সিটিতে বিএনপির বহিষ্কৃতরা জয় পান ১১টিতে।
রাজশাহীতে ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৪টি, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ৫টি ও যুব মৈত্রী ১টিতে জয় পান। সিলেটে ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৫টি, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃতরা ৯টি ও জামায়াত ৫টিতে বিজয়ী হন। বরিশালে ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪ জন আওয়ামী লীগ, ৮ জন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত, ১ জন জাতীয় পার্টি ও ৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন। এ ছাড়া খুলনার ৩১টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ২৮টি, জামায়াত ১টি ও সংরক্ষিত ১টি ওয়ার্ডে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত প্রার্থী বিজয়ী হন।
স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, বেশিরভাগ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভোট ভাগাভাগি হওয়ায় সরকারদলীয় প্রার্থীরা বিএনপির বহিষ্কৃত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। আর দলীয় নানা বিধিনিষেধ, বহিষ্কারসহ নানা সংকট থাকার পরও নিজস্ব জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে বিজয়ী হন বিএনপির বহিষ্কৃতরা।
বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নির্বাচিত কাউন্সিলরদের দাবি, প্রচারে নানা বাধাবিপত্তি ছিল। কোনো কোনো জায়গায় হামলা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটে। এ ছাড়া বিএনপির হাইকমান্ড প্রার্থীদের একযোগে বহিষ্কারাদেশ দেওয়ায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। তাতে বহিষ্কার হওয়া অনেক প্রার্থীর ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ায় পরাজিত হন।
কাউন্সিলর পদে ভোট করা ১১৬ জন বর্তমান ও সাবেক নেতাকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বিএনপি। এর মধ্যে গাজীপুরে ২৯ জন, সিলেটে ৪৩, রাজশাহীতে ১৬, খুলনায় ৯ এবং বরিশালে ১৯ জন রয়েছেন। বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্য থেকে ৩৪ জন কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হন। তাদের মধ্যে গাজীপুরে ১১ জন, সিলেটে ৯, রাজশাহীতে ৫, বরিশালে ৮ ও খুলনায় একজন রয়েছেন।
ভোটে জিতলেও আপাতত বিএনপির বহিষ্কৃতদের দলে ফেরা অনিশ্চিত। ঈদের পর এক দফার আন্দোলন সামনে রেখে শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর দলটির হাইকমান্ড। তাই পদধারী স্থানীয় এসব সাবেক নেতা দলে ফিরতে ক্ষমা চেয়ে যদি আবেদনও করেন, এই মুহূর্তে তা বিবেচনা করার সম্ভাবনা নেই। এ নিয়ে দল এখন ভাবছে না। বিএনপির সব চিন্তাভাবনা এখন আন্দোলনকে ঘিরে। অন্যদিকে দলে ফিরতে এরই মধ্যে দু-একজন কাউন্সিলর আবেদন করেছেন। যারা এখনো আবেদন করেননি, দল চাইলে তারাও আবেদন করবেন। এর আগ পর্যন্ত বিএনপি ও জিয়াউর রহমানের আদর্শের প্রতি অনুগত থেকে দলের জন্য কাজ করে যাবেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো ধরনের নির্বাচনেই অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাঁচ সিটি নির্বাচনে দল অংশ নেয়নি। তবে দলের এ সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। দলে ফিরতে দু-একজন হয়তো এখন আবেদন করতে পারেন। তবে এ ব্যাপারে দলের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। বাকিরাও যদি আবেদন করেন, এ মুহূর্তে সেটা বিবেচনা করার কোনো সম্ভাবনা নেই।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ২৬ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডে তিনবারের মতো কাউন্সিলর নির্বাচিত হন সদর থানা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক হান্নান মিয়া হান্নু। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে দলের কাছে এখনো আবেদন করিনি, ঈদের পরে আবেদন করব। এখন নেতাদের যাকে পাচ্ছি, তার কাছে মৌখিকভাবে ক্ষমা চাচ্ছি। আমরা চাই, সার্বিক বিবেচনায় দল আমাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করুক।’
বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছেন, তাদের ভবিষ্যতে দলে ফেরার একটা সম্ভাবনা থাকবে। আর যারা পরাজিত হয়েছেন, তাদের দু-কূলই গেল।’
রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে চারবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর ও শাহ-মখদুম থানা বিএনপির সাবেক সহসম্পাদক আব্দুস সোবহান লিটন কালবেলাকে বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করে আমাকে ভোটে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। তারপর থেকে আমি দলীয় কোনো পদপদবিতে নেই। দলের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগও ছিল না। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় হঠাৎ করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। পরে শুনলাম, আজীবনের জন্য বাহিষ্কার করা হয়েছে। এখানে বহিষ্কারের কী আছে? আমি তো ২০০৮ সাল থেকে বিএনপির সদস্য পদেও ছিলাম না। সুতরাং আর দলে ফেরার ইচ্ছাও আমার নেই।’
সিলেট সিটি নির্বাচনে ৬ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে পঞ্চমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন ফরহাদ চৌধুরী শামীম। তিনি সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ফরহাদ চৌধুরী শামীম কালবেলাকে বলেন, আমি জিয়াউর রহমানের আদর্শের সৈনিক। দেশের জন্য, দলের জন্য, এলাকার জনগণের জন্য কাজ করি। এলাকায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতেই নির্বাচনে আসা। দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই হবে। দল ডাকলেও থাকব, না ডাকলেও দলীয় কর্মসূচি পালন করব, উপস্থিত থাকব। দল ডাকলে ক্ষমা মুখ্য বিষয় নয়। আমি তো জিয়ার সৈনিক।
মন্তব্য করুন