আবেদ খান
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২০ জুলাই ২০২৩, ০১:০৩ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আবেদ খান

দো মুর্দা এক কবর

ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। ছবি: সংগৃহীত
ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার পুতিন, না পুতিনের রাশিয়া—এই প্রশ্নটি এখন শুধু রাশিয়ার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই নয়, পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনেও আলোড়ন তুলছে। বিশেষ করে পুতিনের একসময়ের আস্থাভাজন ওয়াগনার বাহিনী প্রধানের আকস্মিক বিগড়ে গিয়ে মস্কো অভিমুখে অভিযানের সিদ্ধান্তে পশ্চিমা বিশ্ব যেমন আনন্দিত হয়েছিল এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যেমন উল্লসিত হয়ে উঠেছিলেন, এর মাত্র ২৪ ঘণ্টা পর সেখানকার চিত্রপট সম্পূর্ণ উল্টো গেল। ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন যত বেগে অগ্রসর হয়েছিলেন, তার প্রায় দ্বিগুণ বেগে পশ্চাদপসরণ করলেন। বিদ্রোহের শুরুতে তিনি ক্রেমলিন অভিযানে অভিলাষের কথা কঠোর কণ্ঠে উচ্চারণ করলেও নাটকীয়ভাবেই তার সুর নামিয়ে ফেললেন।

মঞ্চে নামলেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। তিনি প্রিগোজিনকে ফণা নামাতে পরামর্শ দিলেন এবং এটাও বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি পুতিনের পাশেই আছেন এবং ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধটি প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবসায়ী রাষ্ট্রগুলোর মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর আচ্ছাদনে রাশিয়া এবং তার সম-আদর্শের দেশগুলোকে চুরমার করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।

ওদিকে চেচেন নেতা কাদিরভের বাহিনী অতিকৌশলে প্রিগোজিনের ভাড়াটিয়া ওয়াগনার বাহিনীকে ঘিরেই ফেলেছিল।

কাজেই পুতিন-ঘনিষ্ঠ শক্তির রণকৌশল অনুমান করেই ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান প্রিগোজিন বাধ্য হলেন পিছিয়ে যেতে। কারণ সম্ভবত তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে, তিনি যদি এই চরমপন্থা পরিহার না করেন, তাহলে তার বাহিনীর মধ্যেই অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হবে, যার পরিণতি তার জন্যও সুখকর হবে না।

বলা যায়, আপাতত মার্কিনিদের এবং তার অনুসারীদের সব প্রত্যাশার বিপর্যয় ঘটে গেছে। আমি অবশ্য এটার অবসান বলব না, কারণ পশ্চিমা ব্যবসায়ীগোষ্ঠী মাঠে নামে অনেক ধরনের ছক কেটে—নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে থাকে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা ইউক্রেনকে দাঁড় করিয়েছে অন্তত দুই যুগ ধরে। জেলেনস্কিকে তারা টার্গেট করেছিল অনেক আগে থেকেই। এক অনুর্বর মস্তিষ্কের কৌতুকাভিনেতাকে হুট করে রাজনীতির মঞ্চে ঢুকিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে তাকে সার্কাসের ক্লাউন হিসেবে দাঁড় করালেই যে তার পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হয় না, এটা ইউক্রেনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেই যথার্থ প্রতীয়মান হবে।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোকে তাদের স্বার্থের সেবাদাসে পরিণত করার কতগুলো ছকবাঁধা কৌশল অবলম্বন করে। সেই কৌশলের অন্যতম হলো—ব্যাপক উৎকোচ এবং দুর্নীতির জাল বিছিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানসমেত রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক প্রবাহকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলা। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতির বিশাল বৈভবের সাম্প্রতিক হিসাব অবিশ্বাস্য রকমের স্ফীত। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্য যে পরিমাণ সমরাস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে, তার কমিশনের একটি অংশ জেলেনস্কির ব্যক্তিগত ভান্ডারে জমা পড়েছে এবং তারও বিশাল অঙ্ক সঞ্চিত হচ্ছে তার বিদেশের তহবিলে। আগে এই বিপুল সম্পদের ব্যাপারে বিদেশি প্রচারমাধ্যমে তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে।

এখানে আলোচ্য বিষয় জেলেনস্কি নয়; ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান প্রিগোজিন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যিনি তার ভাড়াটিয়া বাহিনী নিয়ে রাশিয়ার পক্ষে বিপুল শক্তিমত্তা প্রদর্শন করলেন, সেই প্রিগোজিন কেন হঠাৎ তার অস্ত্রের নলটি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ধরলেন, সেটাই এখানে ভাববার বিষয়। পাশ্চাত্য প্রচারমাধ্যম পরম আগ্রহ নিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করে নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা জিনিসই প্রকারান্তরে প্রমাণের চেষ্টা করেছে যে, রাশিয়া এবং পুতিনের অন্তিমকাল উপস্থিত। রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই ধারাবাহিক পশ্চিমা প্রচারযন্ত্রের বিষোদ্গার এবং অসত্য প্রচারণা কিন্তু কেবল সাম্প্রতিককালের ব্যাপার নয়। গত প্রায় এক শতাব্দীজুড়ে অব্যাহত রয়েছে এই প্রচার কৌশল এবং চক্রান্তমূলক নানাবিধ আচরণ। সম্ভবত লেলিনোত্তর যুগে বিশেষ করে স্ট্যালিনের সময়ের ওপর লেখা একটি অনবদ্য গ্রন্থ ‘গ্রেট কনস্পিরেসি এগেইনস্ট রাশিয়া’ বইটি পড়েছিলাম সেই ষাটের দশকে এবং তার একটি কপি দীর্ঘকাল আমার সংগ্রহে ছিল। কিন্তু একাত্তরে সেই গ্রন্থটি আমার আরও কিছু বইপত্রের সঙ্গে ভস্মীভূত হয়েছে। পরবর্তীকালে আমি অনেক চেষ্টা করেও এর কোনো কপি সংগ্রহ করতে পারিনি। সম্ভবত নিকিতা ক্রুশ্চেভের আমলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এ বইটি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করে নেয়। এই বইয়ের মধ্যে একজন সিআইএর চর, যার নাম সম্ভবত সিডনি রিলি হবে—তার নানাবিধ নাশকতা কর্মকাণ্ডের লোমহর্ষক বিবরণ সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। (সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে লিখছি বলে এই বইয়ের বর্ণিত বিভিন্ন চমকপ্রদ তথ্য আর সংযোজন করা সম্ভব না)।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়কে নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন গর্বাচেভ আর ইয়েলেৎসিন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চক্রান্তমূলক ভূমিকা পালনের জন্য মিখাইল গর্বাচেভ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। যদিও বিষয়টি এই নিবন্ধের সঙ্গে ততখানী প্রাসঙ্গিক নয়, তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকারী দেশগুলোর নিরন্তর ষড়যন্ত্র এই অংশটুকু উল্লেখ করার অধিকার রাখে।

যাই হোক, সাম্প্রতিক উত্তেজনামূলক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নষ্ট ভাবনাকে কেন্দ্র করে। ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটের অন্তর্ভুক্ত করার নানাবিধ পরিকল্পনা অব্যাহত রেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উদ্দেশ্য ছিল, রাশিয়ার দিকে তাক করে অত্যাধুনিক পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণ। এর ফলে, কৃষ্ণ সাগরসমেত রাশিয়ার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর ওপর খবরদারি করা যাবে। যদিও জেলেনস্কি প্রথম দিকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না, কিন্তু বিপুল উৎকোচ এবং নানাবিধ প্রলোভনের জালে পড়ে এই অরাজনৈতিক কৌতুক অভিনেতা হিসেবে একসময়ের জনপ্রিয়তা অর্জনকারী ব্যক্তিটি পুরোপুরি মার্কিনিদের সেবাদাসেই পরিণত হলেন। এর ফলে যেটা হয়েছে, তা হলো—দেশটির উর্বর বিশাল কৃষিভূমি প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্য পুঁজির স্বার্থ সংরক্ষণের প্রহরী হিসেবে গণ্য হতে থাকে। অতি সংক্ষেপে এটাই হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান পটভূমি।

এরই মধ্যে উত্থান ঘটল ওয়াগনার মারসিনারি গ্রুপ প্রধান প্রিগোজিনের, যিনি একসময় পুতিনের পাঁচক হিসেবে পরিচিত এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে বিপুল শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। এখন পাশ্চাত্য প্রচারমাধ্যম নতুন করে বলতে শুরু করেছে যে, ওয়াগনার নাটক রাশিয়ার সাজানো এবং প্রিগোজিনের উচ্চাশা দমনের আয়োজন মাত্র। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো, যিনি পুতিনের পক্ষে পুরো পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, তিনিই বলেছেন, প্রিগোজিনকে পুতিন নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন। তার ধারণা, ওয়াগনার প্রধান একটু বেশি বেপরোয়া এবং অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছিলেন। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওয়াগনার বাহিনীর বিরুদ্ধে কালো তালিকাভুক্ত করার যে সিদ্ধান্ত সাময়িক স্থগিত রেখেছিল, তা সরিয়ে এখন নতুন করে কালো তালিকা জারি করেছে।

যদিও পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভাবছেন, এটা পুতিনের শেষের শুরু, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ওয়াগনার ঘটনা পুতিনকে অধিকতর বলশালী করেছে এবং এখন তিনি নতুন মিত্রদের আস্থা আরও বেশি করে অর্জন করার সুযোগ পেয়েছেন আর তা তিনি পুরোপুরিই কাজে লাগাবেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে এ ধরনের ঘটনা বেশ কয়েকবার হয়েছে এবং প্রতিবারই তা ক্ষমতাসীনদের অধিকতর শক্তিশালী করেছে আর তারা আরও বলশালী হয়েছে। আমার ধারণা, পাশ্চাত্য শক্তিগুলো এই অঞ্চলকে নিয়ে নতুন কৌশলের ছক কাটছে। এর জন্য ইউক্রেনের জেলেনস্কিকে একটু কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে। ইতিহাস অবশ্য আগামী সময়ের জন্য একটি কবর খুঁড়েই রেখেছে, তার সামনে আছে দুই মুর্দা—একটি হলো জেলেনস্কি এবং তার সাহায্যকারীরা আর অন্যটি হলো—রাশিয়া এবং তার সাথীরা। সময়ই বলে দেবে ওখানে কোন মুর্দার ঠাঁই হবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় অ্যাপোলো ক্লিনিকের যাত্রা শুরু

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালামকে দেখতে হাসপাতালে ডা. রফিক

একাত্তরের ইস্যুর সমাধান চাইল এনসিপি

রাজধানীতে তামাকের বিরুদ্ধে ‘ইয়ুথ মার্চ’

বুড়িগঙ্গা নদী থেকে নারী-শিশুসহ ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার

ত্রিবার্ষিক সম্মেলন / আবারো জামালপুর জেলা বিএনপির নেতৃত্বে শামীম-মামুন

দাবি আদায় ছাড়া ঘরে না ফেরার ঘোষণা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও বস্তিবাসীর

লিডসের বিরুদ্ধে আর্সেনালের গোল উৎসব

আউটসোর্সিং কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত: জোনায়েদ সাকি

এনসিপির কর্মকাণ্ডে ফিরছেন সারোয়ার তুষার

১০

যৌথ বাহিনীর অভিযানে পিস্তলসহ যুবক গ্রেপ্তার 

১১

সাংবাদিকের বাড়িতে চুরি, স্বর্ণালংকারসহ ৫ লাখ টাকার ক্ষতি

১২

৪৫ বছর ভাত না খেয়েও সুস্থ ও সবল বিপ্লব

১৩

চেতনানাশক খাইয়ে দুধর্ষ ডাকাতি

১৪

রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী ঘোষণা

১৫

প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে ছাত্রদলের নির্দেশনা, না মানলে ব্যবস্থা

১৬

নারী শিক্ষার্থীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে চাকরি খোয়ালেন বেরোবি সমন্বয়ক

১৭

হাওর ও চরাঞ্চলের শিক্ষক বদলির তদবির আসে ওপর থেকে : গণশিক্ষা উপদেষ্টা

১৮

জয় স্যুটকেস ভরে টাকা নিয়ে গেছে : সোহেল

১৯

২৫ বছর ধরে বাঁশির মায়ায় আটকে আছে শফিকুলের জীবন

২০
X