দুই ধাপে চূড়ান্ত অসহযোগে যেতে চায় বিএনপি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্ধারিত দিন ঘনিয়ে আসায় একদফার আন্দোলন আরও জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি এবার অসহযোগ আন্দোলনের কথা ভাবছে দলগুলো। চলমান আন্দোলনকে পর্যায়ক্রমে দুটি ধাপে ওই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন নীতিনির্ধারকরা। সাধারণ মানুষের প্রতি নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে অসহযোগের প্রাথমিক প্রক্রিয়া। বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে আজ বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই আহ্বান জানানো হতে পারে। এরপর পর্যায়ক্রমে অসহযোগের এলাকা ও ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তখন দেশবাসীকে অফিস-আদালতে না যাওয়া, যান চলাচল বন্ধ রাখা, কলকারখানা বন্ধ রাখা তথা সরকারকে সর্বোতভাবে অসহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হতে পারে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, জনগণের ভোট প্রত্যাখ্যান করা মানে নির্বাচন আয়োজনে অসহযোগিতা করা। তবে বর্তমান বাস্তবতায় অসহযোগিতার এই আহ্বান কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন বয়কট করে একদফার আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও শরিক দলগুলোর লক্ষ্য এখন ভোট ঠেকানো। এ লক্ষ্যে এবার সর্বাত্মক আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে তারা। পাশাপাশি নির্বাচনে ভোটার ঠেকানোরও পরিকল্পনা করছেন তারা। এর অংশ হিসেবে হরতাল-অবরোধ শক্তভাবে পালনের পাশাপাশি সরকারের ‘একতরফা’ ভোট প্রত্যাখ্যানে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে জনসংযোগ কর্মসূচি নিয়ে আসছে দলগুলো। জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে প্রচারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে দেশবাসীকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র ছাপানো হচ্ছে। দুই পৃষ্ঠার প্রচারপত্রের একপাশে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি এবং অন্য পাশে ঘোষিত নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। আগামী শুক্র অথবা শনিবার থেকে এই প্রচারপত্র বিতরণ শুরু হতে পারে। ভোটগ্রহণের নির্ধারিত দিন ৭ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে সারা দেশে ভোটবিরোধী এই প্রচারপত্র বিলি করা হবে।

জানা গেছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপৎভুক্ত অন্যান্য জোট ও দল পৃথক প্রচারপত্র বিলি করবে। অন্যদিকে যুগপতের বাইরে থাকা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এরই মধ্যে ‘প্রহসনের নির্বাচন বর্জন কর, দুঃশাসন হটাও’ স্লোগানসংবলিত প্রচারপত্র বিলি শুরু করেছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম এরই মধ্যে একাধিক কর্মসূচি থেকে বর্তমান সরকারের অধীনে ‘একতরফা’ নির্বাচনে অংশ না নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ধারণা, বর্তমানে দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও বাংলাদেশে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সরেনি। তাই তাদের এখন চেষ্টা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। আর ভোটাররা বর্জন করলেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। একই সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে না গেলে বিএনপিবিহীন নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের চূড়ান্ত অনাস্থা প্রমাণিত হবে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশ্বে নির্বাচন আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেটা হলে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি। সারা দেশে তাদের ব্যাপক জনসমর্থন এবং অসংখ্য নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছে। তৃণমূলে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত কর্মী-সমর্থক রয়েছে। দলের সিদ্ধান্তে তারা একতরফা নির্বাচন বয়কট করবে। এখন অন্য দল ও নিরপেক্ষ ভোটারদের ৭ জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ফের ক্ষমতায় থাকতে একটি একতরফা, পাতানো, ডামি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা জনগণকে এই নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছি। তারা এরই মধ্যে একতরফা তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাদের প্রত্যাশা, গণতন্ত্রের স্বার্থে চূড়ান্তভাবে তারা ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করবে, জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবে না।’

বিএনপির পাশাপাশি জনগণকে ‘একতরফা’ ভোট বর্জনের আহ্বান এবং ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে গণসংযোগ চালাবে গণতন্ত্র মঞ্চ। মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘আগামী ৭ জানুয়ারি যে একতরফা, ভাগবাটোয়ার নির্বাচনের আয়োজন চলছে, এরই মধ্যে জনগণের বিপুল অংশ সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ও বর্জনের ডাকটা অব্যাহত রাখব। একদিকে যেমন হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি থাকবে, পাশাপাশি দেশের প্রতিটি ঘরে এই প্রত্যাখ্যানের ডাক পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। এক্ষেত্রে আমরা প্রচারপত্রসহ বিভিন্ন প্রচার উপকরণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহকে ব্যবহার করব। এর পাশাপাশি সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, পথসভা, উঠান বৈঠক, খণ্ড মিছিলের মতো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভোটে না গিয়ে তা চূড়ান্ত বর্জনের জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানানো হবে। সহিংসতা-উসকানিতে পা না দিয়ে যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ পথে আমরা এই তৎপরতা অব্যাহত রাখতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘মানুষ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে, ভোট প্রত্যাখ্যান-বর্জন করার মধ্য দিয়েও নির্বাচনের প্রতি তাদের অসহযোগিতা ব্যক্ত করতে পারে। অসহযোগিতার ক্ষেত্র-পরিধি আরও বিস্তৃত হবে কি না, মাত্রা ও গভীরতা কেমন হবে, সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।’

গত সোমবার প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন প্রার্থীরা। এখান থেকে ভোট পর্যন্ত সময়কে চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য ‘মোক্ষম সময়’ হিসেবে বিবেচনা করছে বিএনপি ও শরিকরা। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞায় সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনের মতো জমায়েতের কর্মসূচি করতে না পারলে হরতাল-অবরোধ অব্যাহত থাকবে। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার আবার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি আসতে পারে। জানা গেছে, চলতি মাসের শেষ দিক থেকে ভোট পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অত্যন্ত শক্তভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এই সময়ে জামায়াতে ইসলামীও যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।