সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের একটি অনুসন্ধান কূপের ক্ষতি করার পরও চীনের অদক্ষ কোম্পানি সিনোপ্যাক আরও পাঁচটি কূপ খননের কাজ পাচ্ছে। এতে গ্যাসক্ষেত্রটির যে কোনো মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট গ্যাস ফিল্ড না সিনোপ্যাক; কার দক্ষতার অভাবে সিলেট-১০ নম্বর অনুসন্ধান কূপের নির্দিষ্ট গভীরতায় খনন করা যায়নি, তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
কারণ, বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানি সিলেটে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করেছে এবং গ্যাসক্ষেত্র পুড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে দেশের।
ফলে সিলেট-১০ অনুসন্ধান কূপ খনন নিয়ে তদন্ত করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে নাইকো ও অক্সিডেন্টাল কোম্পানির মতো সিনোপ্যাকের মাধ্যমেও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সিলেটে-১০ কূপ খননে কোনো অনিয়ম বা আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে কি না, বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত চীনের এ প্রতিষ্ঠানকেই ফের আরও পাঁচটি কূপ খননের দায়িত্ব দেওয়া উচিত হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুক্তি অনুযায়ীই সিনোপ্যাক কাজ করেছে। হাইপ্রেশারের কারণে নির্দিষ্ট গভীরতায় খনন করা যায়নি। এই কূপের সফলতা শতভাগ। সিলেট-১০ কূপ খনন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪৯ কোটি টাকা। এই ব্যয়ে ৩ হাজার ৩০০ মিটার গভীরে খননের কথা থাকলে খনন করা হয়েছে আড়াই হাজার মিটার। বাকি ৮০০ মিটার খনন করা হয়নি। এজন্য ব্যয় স্বাভাবিকভাবে কমে আসার কথা। কিন্তু ৮০০ মিটার কম খননের পরও কূপ খননের পুরো টাকাই পরিশোধ করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘সিলেট-১০ কূপে সিনোপ্যাক নির্ধারিত গভীরতায় যেতে পারেনি কে বলেছে। যারা বলেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলুন।’ এর বেশি তিনি আর কোনো কথা বলেননি।
ডিসেম্বরে সচিবালয়ে সিলেট-১০ নম্বর কূপে তেল-গ্যাস পাওয়া নিয়ে ব্রিফিং করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরিুল হামিদ বিপু। ওই সময় প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ৩ হাজার ৩০০ মিটার গভীরতায় কূপ খননের কথা থাকলেও উচ্চচাপের কারণে খনন করা সম্ভব হচ্ছে না। এই স্তরে ৬ হাজার পিএসআইর বেশি চাপ।
সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, সিলেট-১০ কূপ খননের কাজটি ঠিক আছে। যে গভীরতায় যাওয়ার কথা ছিল, তাতে উচ্চচাপের কারণে আমরা যেতে পারিনি। যদি যেতাম, তাহলে ব্লো-আউট (বিস্ফোরণ) হতে পারতে।
এর চেয়ে বেশি প্রেশারের কূপ থেকে দেশে গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে, এখানে কেন হলো না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জকিগঞ্জে এর চেয়ে বেশি প্রেশারের কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে, বলা হচ্ছে; কিন্তু জকিগঞ্জে গ্যাস ওঠানোর প্রেশার ছিল ১ হাজার ২০০ পিএসআই। আর সিলেট-১০-এ সাড়ে ৪ হাজার। তিনি বলেন, এই কূপের পাশে আরেকটি কূপ খনন করা হবে। তখন একেবারের নিচের স্তর থেকে তেল-গ্যাস উত্তোলন করা হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন জানা গেছে, সিলেট-১০ নম্বর কূপে গ্যাসের উচ্চচাপের কারণে নির্ধারিত গভীরতা পর্যন্ত কূপ খনন না করায় এখন কূপটির পাশেই আরেকটি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে এসজিএফএল। এতে একইস্থানে একটি কূপের জায়গায় দুটি কূপ খনন করতে হচ্ছে। এরই মধ্যে কূপ খননে ব্যয় হয়েছে ১৪৯ কোটি টাকা। আরেকটি কূপ খননেও একই পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, যা সরকারের ক্ষতি।
জিওলজিক্যাল টেকনিক্যাল অর্ডার (জিটিও) অনুযায়ী কূপটি ৩ হাজার ৫০০ মিটার গভীরে খনন করার কথা। দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপের ফলসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই জিটিও করেছিল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। জিটিওতে তো স্পষ্টভাবেই বলা ছিল, একটি পর্যায়ে গিয়ে উচ্চচাপ থাকবে। এর পরও সিনোপ্যাক পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে কূপ খনন শুরু করেনি বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, উচ্চচাপের ধারণা দেওয়ার পরও সিনোপ্যাক সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়নি। বাপেক্স এই গভীরতায় খনন করতে পারবে না বলে সিনোপ্যাককে কাজটি দেওয়া হয়। কিন্তু সিনোপ্যাক ২ হাজার ৫৭৬ মিটার পর্যন্ত খনন করেছে।
জানা গেছে, সিলেটের জকিগঞ্জে রাষ্ট্রীয় অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স যে কূপটি খনন করে, সেটিতে চাপ ৬ হাজার ৩০০ পিএসআইজি ছিল। সিলেট-১০ কূপে সর্বোচ্চ চাপ ছিল ৫ হাজার ৮০০ পিএসআইজি। এর মানে জকিগঞ্জের তুলনায় এখানে চাপ অনেক কম থাকার পরও সিনোপ্যাক খননকাজ করতে পারেনি।
জানা গেছে, ২ হাজার ৫৭৬ মিটার পর্যন্ত খনন করতেই দুবার পাইপ আটকে গিয়েছিল। প্রস্তুতি নিয়ে কূপ খনন করা গেলে বর্তমানে ৬ হাজার পিএসআইজি চাপ কোনো ব্যাপার নয়। দক্ষতার অভাবের কারণে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো যায়নি। এতে কূপটিতে গ্যাসের বড় একটি অংশ মাটির নিচে থেকে যাচ্ছে। ফলে ক্ষতি হয়েছে দেশেরই। চুক্তি অনুযায়ী ১৪৯ কোটি টাকায় কূপটি ৩ হাজার ৩০০ মিটার গভীর পর্যন্ত খনন করার কথা। কিন্তু ওই পর্যন্ত খনন না করলেও চুক্তি পুরো টাকাই পাচ্ছে সিনোপ্যাক। কূপ খননের আন্তর্জাতিক নিয়ম হচ্ছে, প্রথম সবচেয়ে নিচের স্তরের গ্যাস তুলতে হয়। তা না হলে সবশেষ স্তরের গ্যাস নষ্ট হয়ে যাবে। এই অবস্থায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি নিয়ে তদন্তের দাবি করেছেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, প্রথমে দেখতে হবে খনন পরিকল্পনা কেমন ছিল। সিনোপ্যাক যদি খনন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ না করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি সিলেট গ্যাস ফিল্ড খনন পরিকল্পনায় ভুল করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য তদন্ত হওয়া দরকার। তিনি বলেন, সিলেটে নাইকো ও অক্সিডেন্টালের মতো বহুজাতিক কোম্পানির অধীনে থাকা ফিল্ডে ব্লো-আউটের (বিস্ফোরণ) ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের কোনো কূপ খনন নিয়ে অবহেলা করা যাবে না।
অভিযোগ রয়েছে, সিনোপ্যাকের খুব গভীরে অনুসন্ধান কূপ করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এ অবস্থায় সিলেট-১০ কূপ নিয়ে তৈরি ধোঁয়াশা কাটাতে হলে তদন্ত প্রয়োজন। তদন্ত করে সঠিক তথ্য-উপাত্ত বের করা দরকার। কারণ, সামান্য ভুলে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। এ অবস্থায় সিনোপ্যাককে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের আরও পাঁচটি কূপ খননের ঠিকাদারির কাজ দেওয়া বিপজ্জনক। যদিও এরই মধ্যে বিশেষ বিধান আইনের আওতায় চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোপ্যাককে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন কাজটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পৃথক তিন ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) আওতায় এসব কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে চারটি অনুসন্ধান ও একটি উন্নয়ন কূপ রয়েছে। অনুসন্ধান কূপগুলো হচ্ছে রশীদপুর-১১ ও ১৩, কৈলাশটিলা-৯ এবং সিলেটের ডুপি টিলা-১। আর একমাত্র উন্নয়ন কূপ সিলেট-১১। এতে মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার মতো।