রাজধানীর উত্তরা এবং আশপাশের এলাকার গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের চিকিৎসা গ্রহণে মূল ভরসা কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল। অথচ এই হাসপাতাল ঘিরে চলছে সীমাহীন অনিয়ম আর দুর্নীতির মহোৎসব। এর মধ্যে দন্ত ও প্যাথলজি বিভাগের জরুরি পণ্য কেনাকাটায় বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। দাঁতের রুট ক্যানেলের পর ফিলিং করতে সিলভার অ্যালয় নামে এক ধরনের ধাতবের প্রয়োজন হয়। বিদেশ থেকে আমদানি করা ৩০ গ্রাম সিলভার অ্যালয়ের বাজারদর আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা। কিন্তু কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের জন্য সেই পণ্য কেনা হয়েছে লাখ টাকায়। এখানেই শেষ নয়; ২০০ টাকার টেম্পারেচার চার্ট হোল্ডার কেনা হয় সাড়ে ৫ হাজার টাকায়। কয়েক গুণ দামে হলেও এসব পণ্য তবু কেনা হয়েছে, এক্স-রে ফিল্ম না কিনেই ভুয়া বিল করে কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রচার ও বিজ্ঞাপন খাতের টাকা লোপাট হয় ভুয়া সাইনবোর্ডের নামে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয়সহ কেনাকাটায় রয়েছে আরও নানা অনিয়মের অভিযোগ। এসব অভিযোগের আঙুল উঠেছে হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ও বর্তমান সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মাহফুজ আরা বেগম এবং শিশু বিভাগের আবাসিক ফিজিশিয়ান (আরপি) ডা. মো. ইমরুল হাসানের বিরুদ্ধে।
হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডা. মো. ইমরুল হাসান শিশু বিভাগের চিকিৎসক হলেও সেখানে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। হাসপাতালের কেনাকাটা-সংক্রান্ত বিষয়ে তাকে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। নিয়ম অনুযায়ী এক ব্যক্তির একাধিক কমিটিতে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু ডা. ইমরুল হাসান নিয়মবহির্ভূতভাবে হাসপাতালের ক্রয়-পরিকল্পনা, মূল্যায়ন, সার্ভেসহ সব কমিটিতে রয়েছেন। তার এসব অনিয়মে সরাসরি সহায়তা করে আসছেন ডা. মাহফুজ আরা বেগম। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক পদে দায়িত্ব পালনকালে ইমরুল হাসানকে এসব কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর দুজনে মিলে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর ২০ মার্চ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পারসোনেল-২ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব আলমগীর কবীর স্বাক্ষরিত এক নোটিশে নিয়মিত তত্ত্বাবধায়ক পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত ডা. মাহফুজ আরা বেগমকে সাময়িকভাবে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণের পর তার অনুসারী ডা. মো. ইমরুল হাসানকে নিয়ে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি ২৯৩টি চিকিৎসাসামগ্রী কেনার উদ্যোগ নেয় কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এসব সামগ্রীর কেনাকাটায় সরাসরি জড়িয়ে পড়েন ডা. মাহফুজ আরা বেগম ও ডা. মো. ইমরুল হাসান। লট (একসঙ্গে অনেক পণ্য) আকারে পণ্যের দরপত্র আহ্বান করেন তারা। এ ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল সাইফুল ইসলাম ট্রেড ও মিতুল এন্টারপ্রাইজ। তাদের মাধ্যমে বাজারের চেয়ে বহুগুণ বেশি দামে বিভিন্ন পণ্য কেনা হয়।
রাজধানীর পুরানা পল্টন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমএ) ভবনের সার্জিক্যাল মার্কেটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দাঁতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিশেষ ধাতব সিলভার এলয় প্রতি ৩০ গ্রামের বাজারমূল্য আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা।
ভবনের দ্বিতীয়তলার রাজিব ডেন্টাল অ্যান্ড সার্জিক্যালের বিক্রয়কর্মী খোরশেদ আলম জানান, তাদের কাছে সুইডেন, ইতালি ও ভারতীয় কোম্পানির সিলভার এলয় আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম সুইডেনের, এরপর ইতালির আর সবচেয়ে কম দাম ভারতীয় সিলভার এলয়ের। এসব পণ্য আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকায় পাওয়া যায়।
অথচ কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ৩০ গ্রামের সেই সিলভার এলয় কেনা হয়েছে ১ লাখ টাকায়।
দুই চিকিৎসকের পদে পদে অনিয়ম: বাজারমূল্যের চেয়ে ৪০ গুণ বেশি দামে সিলভার এলয় কেনাকাটাতেই অনিয়মের শেষ নয়; ২০০ টাকার টেম্পারেচার চার্ট হোল্ডার কেনা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার টাকায়। সাইনবোর্ডের কোটেশন করে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ভুয়া বিলের মাধ্যমে এক্স-রে ফিল্ম না কিনেও কোটি টাকার বিল তোলা হয়েছে। আউটসোর্সিং এবং রোগীদের ওষুধসামগ্রী সরবরাহের কাজে নিয়মনীতি না মেনে অবৈধ চুক্তির মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়ে কারসাজি করেন দুই চিকিৎসক ডা. মাহফুজ আরা বেগম ও ডা. মো. ইমরুল হাসান। নিয়মবহির্ভূতভাবে সাইফুল ট্রেড লিঙ্ক থেকে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে ক্রয় করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হাসপাতালের ওষুধ ও প্যাথলজি বিভাগের কেনাকাটার কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য অনিয়মের সহযোগী মিতুল এন্টারপ্রাইজ ও সাইফুল ট্রেড লিঙ্কসহ আরও অন্তত চারটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছেন এই দুই চিকিৎসক। এভাবে তারা কেনাকাটায় অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। উত্তরার দিয়াবাড়ী, গুলশান ও বনানীতে তাদের একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট থাকার কথা জানা গেছে। ব্যাংকে নামে-বেনামে এফডিআরও রয়েছে তাদের।
হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক জানান, ডা. মাহফুজ আরা বেগম ও ডা. ইমরুল হাসানের দুর্নীতির তথ্য কেউ যেন জানতে না পারেন, এজন্য স্টোরকিপারকে বাদ দিয়ে ক্রয়কৃত মালপত্র নিজেরা গ্রহণ করতেন। হাসপাতালের স্টোরকিপারকে বাদ দিয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ডা. ইমরুলসহ তিন চিকিৎসকের স্বাক্ষরের পণ্য বুঝে রাখার একটি কাগজ কালবেলার হাতে এসেছে।
এদিকে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের অপকর্মের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত ও শাস্তির দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। গত ১৪ ও ২৩ জানুয়ারি তাদের কাছে পৃথক দুটি চিঠি পাঠানো হয়। অভিযোগের কপি কালবেলার হাতে এসেছে।
অভিযোগের বিষয়ে যা বললেন দুই চিকিৎসক: ডা. মো. ইমরুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘সহকারী পরিচালক ম্যাডাম (ডা. মাহফুজ আরা বেগম) যখন ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, তখন তিনি তিনটি কমিটি করেছিলেন। সেখানে তিনি আমাকে রেখেছিলেন। তখন লট আকারে প্রয়োজনীয় পণ্য কেনা হয়েছিল। ধরুন, আপনি ১০০টি আইটেম একসঙ্গে লট আকারে কিনতে যাচ্ছেন। তখন অংশগ্রহণকারী দরদাতারা প্রত্যেকে একটি করে দর দেন। এর মধ্যে সবচেয়ে কম দরদাতাই কাজটা পাবেন। লটে কেনা জিনিসের মোট আইটেমের মধ্যে কোনোটির দাম কম দিতে পারেন, কেউ আবার কোনোটির দাম বেশি দিতে পারেন। সবচেয়ে কম যিনি দাম দেন, তিনিই কিন্তু কাজটা পান। এগুলো নিয়ে এখন মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মাহফুজ আরা বেগমও। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘একটি মহল আমার পেছনে লেগেছে। তারাই আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে।’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বক্তব্য: কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. শিহাব উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, অভিযোগের বিষয়টি জেনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শৃঙ্খলা বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. এবিএম শামসুজ্জামান বলেন, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে কেনাকাটায় অনিয়মের একটি অভিযোগ এসেছে তাদের কাছে। অভিযোগের বিষয়ে ফাইল উত্থাপনের জন্য শৃঙ্খলা শাখার সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি। শিগগির ফাইল উত্থাপন করা হবে। ফাইল উত্থাপনের পর বিশ্লেষণ করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।