ঢাকা নগরীর গা ঘেঁষা কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার। বছরতিনেক আগেও বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিল কৃষিজমি। নানা ফসলে সুশোভিত ছিল মাইলের পর মাইল। রাজধানীর বাজারে পাওয়া যেত এখানকার টাটকা শাকসবজি, মাছ এবং ফলমূল। সেসব এখন অতীত। তিন ফসলি জমি, খাল এবং পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক প্রকল্প। দখলের ফাঁদে ফেলে এলাকাছাড়া করা হয়েছে গরিব কৃষকদের। অনেক পরিবারকে গায়ের জোরে উচ্ছেদ করে কৃষিজমি, ভিটেমাটির দখল নিয়েছে হাউজিং কোম্পানি। এখনো যারা পৈতৃক ভিটার মাটি কামড়ে আছেন, তাদের মধ্যেও বিরাজ করছে আতঙ্ক। কারণ প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি দিচ্ছে কোম্পানির ‘মোটরসাইকেল বাহিনী’। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়মনীতি থোরাই কেয়ার করলেও মুখে কুলুপ এঁটে আছে কর্তৃপক্ষ। সেই সুযোগে দখলের সীমানা বেড়েই চলেছে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ফুলেফেঁপে উঠেছে ‘আঁটি মডেল টাউন’ নামের এই প্রকল্প—স্থানীয়ভাবে যা সুজন হাউজিং নামে পরিচিত।
স্থানীয়রা বলছেন, ২০১২-১৩ সালের দিকে মাত্র কয়েক বিঘা জমি নিয়ে যাত্রা শুরু করে আটি মডেল টাউন। চারপাশ উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এ হাউজিং প্রকল্পের অবস্থান ছিল আঁটিবাজার সংলগ্ন। স্থানীয় ইবরাহিম মিয়া সুজন নামে এক ব্যক্তি ২১ জন শেয়ারহোল্ডার নিয়ে এই হাউজিং কোম্পানি গঠন করেন। টিনশেডের দুই রুমের ছোট্ট একটি অফিসে কার্যক্রম চালাতেন। তবে কয়েক বছর ঘুরতেই বেশিরভাগ শেয়ারহোল্ডারকে বিতাড়িত করেন তিনি। এরপর ধীরে ধীরে শুরু করেন হাউজিং সম্প্রসারণ। শুরুর দিকে অবশ্য বাজারদরেই মালিকদের কাছ থেকে জমি কিনে নেওয়া হতো। প্রভাবশালী এক রাজনীতিবিদের নাম ভাঙিয়ে ২০১৭-১৮ সালের দিকে শুরু হয় হাউজিং সম্প্রসারণের নামে দখল বাণিজ্য।
আঁটি মডেল টাউনের অনুমোদন না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘কেরানীগঞ্জের কোনো আবাসন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই। এর পরও অনেকে জোর করে জমি দখল করে আবাসন প্রকল্প করছেন। এসব বন্ধে শিগগির অভিযান চালানো হবে।’
স্থানীয়রা বলছেন, ২০২১ সালের শেষের দিকে আঁটিবাজারের আশপাশের সব ফসলি জমিতে বালু ফেলা শুরু করেন ইবরাহিম মিয়া সুজন। প্রথমদিকে জমির মালিকরা বালু ভরাটের প্রতিবাদ করলেও প্রভাবশালী একজন রাজনীতিকের আত্মীয় পরিচয়ে ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেন সুজন। এর বাইরেও স্থানীয় সরকারদলীয় নেতাদের একাংশের আশীর্বাদ আদায় করে নেন। এরপর সুজনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আঁটি মৌজা এবং বলসতা মৌজার বেশিরভাগ খালি জমি বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলেন। বর্তমানে আঁটি মডেল টাউনের আয়তন হাজার একরেরও বেশি। এর অধিকাংশই ভয় দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যের বিনিময়ে দখল করা হয়েছে।
সরেজমিন আঁটি মডেল টাউন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে দখলে নেওয়া মাইলের পর মাইল এলাকায় উন্নয়ন কাজ চলছে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকায় চলছে বালু ভরাট। হাউজিং এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটরসাইকেল বাহিনী। বহিরাগত কোনো ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করলেই পড়তে হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে। সাংবাদিক পরিচয় লুকিয়ে জমির ক্রেতা হিসেবে সুযোগ মেলে হাউজিং এলাকা ঘুরে দেখার। এজন্য পাড় হতে হয় বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকি। এ ছাড়া কিছুক্ষণ পরপরই মোটরসাইকেল বাহিনীর সদস্যদের জেরার মুখেও পড়তে হয়।
আঁটিবাজারের পাশেই আব্দুর রউফ মিয়ার বাড়ি। বংশপরম্পরায় তারা বাস করেন এ এলাকায়। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও এসব জমিতে বছরে তিনবার ফসল হইতো। এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। কিন্তু হঠাৎ সুজন মিয়া একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম ভাঙিয়ে এসব জমি দখল শুরু করেন। রাতের আঁধারে বালু ফেলেন কৃষিজমিতে। এরপর বাধ্য করেন জমি বিক্রি করতে। কম দামে এসব জমি কিনে সুজন বেশি দামে মানুষের কাছে বিক্রি করেন।’
আঁটি মডেল টাউনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আশরাফুল নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘যতদূর দেখতে পাবেন সবই কৃষিজমি ছিল। মাঝেমধ্যে ছিল কৃষক এবং স্থানীয়দের বাড়ি। কিন্তু তিন বছর ধরে এ এলাকা দখলে নিয়েছে সুজন হাউজিং। জমির মালিকের অনুমতি ছাড়াই রাতের আঁধারে বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়। পরে জমির মালিক প্রতিবাদ করলে বালু ভরাট বাবদ শতাংশ প্রতি তিন লাখ টাকা দাবি করা হয়। পাশাপাশি হাউজিংয়ের রাস্তা বাবদ ২৫ শতাংশ জমি ছেড়ে দিতে বলা হয়। এ ছাড়াও গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির লাইন বাবদ দাবি করা হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। এরপর বলা হয়, আমরা আপেনাকে উচ্ছেদ করব না। আপনি আপনার জায়গায় থাকেন কিন্তু এই নিয়ম মেনে থাকতে হবে। এভাবে অসহায় কৃষকরা এক পর্যায়ে জমি থেকে উচ্ছেদ হয়।’
তিনি জানান, ‘স্থানীয়রা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লাভ নেই। কারণ প্রভাবশালীরা সবাই সুজনের পক্ষে। এ ছাড়া সুজন দেশের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিকের নাতি পরিচয় দেন। ফলে সাধারণ মানুষ ভয়ে আর এগোতে চান না।’
আঁটি মডেল টাউনের প্লট বিক্রির পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া না গেলেও সূত্র বলছে, তাদের পুরোনো সিটির সব প্লট বিক্রি হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ অনুমোদনবিহীন এই প্রকল্পের বেশিরভাগ প্লটে উঠে গেছে বহুতল ভবন। প্লট কিনে যারা এসব স্থাপনা নির্মাণ করেছেন, তাদেরও যথাযথ অনুমোদন নেই। তা সত্ত্বেও দখলে নেওয়া নতুন নতুন এলাকা হাউজিংয়ের অন্তর্ভুক্ত করে সেখানেও শুরু হয়েছে প্লট বিক্রি।
অন্তত সাত দিন হাউজিং কোম্পানির দখলে নেওয়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই বাড়ছে দখল করা জায়গা। আশপাশের এলাকায় বালু ফেলে সম্প্রসারণ হচ্ছে। বালু ফেলার পরে স্থানীয় অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আবাস গেড়েছেন। আবাসন প্রকল্পের মধ্যেই এমন কিছু বাড়ি চোখে পড়ে এই প্রতিবেদকের। যেখানে দেখা যায় সাজানো-গোছানো বাড়িঘর। গাছগাছালিঘেরা বাড়িতে কেউ থাকেন না। চারদিকে বালুর স্তূপ। ঘরের তালায় মরিচা ধরে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় এ বাড়িতে দীর্ঘদিন পা পড়ে না মালিকদের।
বালু ভরাট করা এলাকার পাশে এখনো বাস করছে কয়েকটি পরিবার। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে গেলে তারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। এক আলাপচারিতায় তারা বলেন, ‘কতদিন থাকতে পারব জানি না। চারপাশে বালু ভরাট চলছে। প্রায় প্রতিদিনই চলছে এলাকা সম্প্রসারণ। হয়তো আমাদেরও এলাকা ছাড়তে হবে।’
আঁটিবাজার এবং আশপাশের এলাকা ঘুরে অসংখ্য ভুক্তভোগীর দেখা পাওয়া গেছে, যারা হারিয়েছেন বাপ-দাদার ভিটে ও কৃষিজমি। অনেকে প্রতিবাদ করলেও ভূমিদস্যুদের সঙ্গে টিকতে না পেরে এলাকাছাড়া হয়েছেন।
হাউজিং এলাকার মধ্যে এখনো কয়েকটি পরিবার বসবাস করে। যাদের প্রায় সবাই দিন আনে দিন খায়। তারা বলেন, ‘চারপাশে বালু ভরাট করে ফেলা হয়েছে। আমাদের উঠানও বালিতে পূর্ণ। সর্বত্র বালু আর বালু। দিনরাত হুমকি-ধমকি চলছে এলাকা ছাড়ার। কিন্তু বাপের ভিটে ছেড়ে আমরা কই যাব। দিন আনি দিন খাই। কৃষিকাজ করতাম, কিছু গরু-ছাগল পালন করতাম। এতেই সংসার বেশ চলে যেতে। কিন্তু এখন বাড়ি ছেড়ে কোথায় গিয়ে উঠব?’
এই প্রতিবেদককে এলাকা ঘুরিয়ে দেখান ১২ বছরের এক কিশোর। তার কাছ থেকে জানা যায়, কোথায় পুকুর ছিল, খেলার মাঠ ছিল। দলবেঁধে পুকুর এবং খালে সাঁতার কাটার গল্প বলতে গিয়ে দুচোখ ছলছল করে ওঠে তার।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমার কাছে এ বিষয়ে অনেকবারই এলাকার লোকজন এসেছিলেন। আমি চেষ্টা করেছি প্রতিকার করার জন্য। রাতের অন্ধকারে একটা গ্রুপ ওখানে মানুষের জায়গা-সম্পত্তি ভরাট করে ফেলেছে। চুপিসারে বিভিন্ন রকমভাবে তারা এ কাজটি করেছে। এটি অবৈধ, আমি রাজউকের দৃষ্টি আর্কষণ করি, রাজউকের এখানে একটা বড় রোল-প্লে করার সুযোগ আছে। আইনগতভাবে আমার যা করণীয় আমি করব। তারা বিভিন্ন রকম সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছে, সাইনবোর্ড দিতে গেলে লোকাল গভর্নমেন্টের একটা অনুমোদন লাগে। তারা কোনো অনুমোদন নেয়নি, কোনো ধরনের এনওসি নেয়নি। তারা রাতের আঁধারে বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এ ধরনের কাজগুলো করেছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো হাউজিংয়ে বিভিন্ন শ্রেণির প্লট তৈরি করা হয়েছে। আড়াই কাঠা, ৩ কাঠা, ৫ কাঠা এবং এরচেয়ে বেশি আয়তনের প্লটও রয়েছে এখানে। কাঠাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ত্রিশ লাখ থেকে সত্তর লাখ টাকা পর্যন্ত। বেশ কয়েকটি প্লটে ক্রেতাদের নতুন নামফলক লাগানো।
কথা বলার জন্য পরপর তিন দিন আঁটি মডেল টাউন আবাসন প্রকল্পের অফিসে যান এ প্রতিবেদক। সেখানে কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষী জানান, অফিসে কেউ নেই। এরপর হাউজিংয়ের মালিক ইবরাহিম মিয়া সুজনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের জন্য বারবার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল নম্বর এবং হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও জবাব দেননি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তা মইনুল হকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে তার কোনোটিই সত্য নয় দাবি করে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ কে করেছে আপনার কাছে। আপনার বিরুদ্ধে যদি আমি বলি, আমার কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাহলে আপনি মানবেন?’
অভিযোগের প্রমাণ রয়েছে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এসব করেই থাকি, তাহলে প্রশাসন তো আর অন্ধ নয় যে, চোখে দেখবে না। এটা তো এমন নয় যে, আমার পকেটের মধ্যে লুকাই রাইখা দিলাম হাউজিংটা। আমি যদি অবৈধভাবে করেই থাকি—এটা তো ছোট জিনিস না, জর্দার কৌটা না যে পকেটে লুকাই রাখলাম, কেউ দেখল না। আমরা যা করছি স্বচ্ছভাবে করতেছি। লুকোচুরির কিছু নাই।’
খোদ রাজধানীর পাশে হাউজিংয়ের নামে এমন অবৈধ কার্যক্রমে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরাও। তারা বলছেন, রিয়েল এস্টেট আইন, ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ), জলাধার সংরক্ষণ আইন, ইমারত নির্মাণ আইন ও পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন দখলের উৎসব চলছে। সরকারি এতোগুলো সংস্থা থাকতে অনুমোদনহীন একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান কীভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে? সংস্থাগুলোর রহস্যজনক নীরবতায় প্লট কিনে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ ক্রেতা। সরকারও রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলে পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলার সুযোগ হারাচ্ছে বলেও মত দেন অনেকে।
পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র শাখা) সাবরিন সুলতানা কালবেলাকে বলেন, ‘তারা (আঁটি মডেল টাউন) আমাদের কাছে পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিল। তাদের এখনো ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। ছাড়পত্রের বিষয়টি প্রসেসিংয়ে আছে। আর তারা যদি খাল-জলাশয় ভরাট করে, পরিবেশের ক্ষতি করে; আপনাদের কাছে প্রমাণ থাকলে আপনারা সংবাদ প্রকাশ করেন।’