দুরন্ত আহনাফ তাহমিদ আয়হামের (১০) ঘরে সবকিছু আছে, শুধু সে আর নেই দুনিয়ায়। চশমা, শখের ডায়রি, পড়ার টেবিল আর খেলনা; সব রেখে আয়হাম এখন নানার কবরের পাশে শায়িত। দেড় মাস আগে সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর সন্তানের খতনা নিয়ে ভয় পেয়েছিলেন ফখরুল আলম। তাই নিকটাত্মীয় ডা. মোক্তাদিরের ওপর ভরসা রেখেছিলেন। মোক্তাদির সাহস দিয়েছিলেন, ছোট অস্ত্রোপচার, ভয়ের কিছু নেই। তার কথামতো ৫ হাজার টাকায় খতনার চুক্তি হয় মালিবাগ জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে। গত মঙ্গলবার বাবার সঙ্গে গিয়েছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়হাম। ছোট অস্ত্রোপচারে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া না দিয়ে ফুল অ্যানেসথেসিয়া দিয়েছিলেন চিকিৎসক। অতিরিক্ত অ্যানেসথেসিয়ায় আর জ্ঞান ফেরেনি আয়হামের। দুরন্ত সন্তানের নিথর দেহের কফিন ওঠে বাবার ঘাড়ে। গত বুধবার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় নানার কবরের পাশে দাফন করা হয় আয়হামকে।
রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট মোড়ে তিলপাপাড়া সড়কের (প্রথম বাসা) চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকে আয়হামের পরিবার। রাস্তার মোড় থেকে দেখা যায় ভবনের সামনে মানুষের জটলা। কেউ এসেছেন পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে। কেউ আবার স্মৃতিচারণ শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন আয়হামদের ভবন থেকে। ভবনের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই কানে ভেসে আসে আয়হামের মায়ের কান্নার আওয়াজ। ভিড় ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখা যায়, টেবিলে সাজানো বই। চশমাটা পড়ে আছে ডায়েরির ওপরে। আয়হামের মা চুমকি সন্তানের জামাকাপড় আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন। ফখরুল-চুমকি দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে আয়হামই বড়। ছোট ছেলে আয়মান প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। যে কোনো কথা বললে কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই মেনে নিত আয়হাম। পরিবারের কাছে মায়ের একান্ত অনুগত ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল সে। বলা হতো, ছোট ছেলে বাবার মতো হলেও আয়হাম হয়েছে ঠিক মায়ের মতোই। ঘটনার দিন কালো প্যান্ট, কালো টি-শার্ট ও একই রঙের জুতা পরে বাচ্চাটা গেল। হাসিমুখে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকল অথচ লাশ হয়ে বের হলো। বড় ভাই আয়হাম কতটা প্রিয় আধো আধো কণ্ঠে তা বলছিল ছোট ভাই আয়মান। শিশুটি জানায়, ভাইয়া সবসময় যেখানে যেত আমাকে নিত। রাতে একসঙ্গেই আমরা ঘুমাতাম। ভাইয়া এখন নেই, আমি কার সঙ্গে খেলব।
আয়হামের বাবা ফখরুল আলম বলেন, সম্প্রতি ইউনাইটেড হাসপাতালে আয়ানের ঘটনার পর আমাদের মনে কিছুটা ভয় জাগে। এক আত্মীয়ের স্বজন ছিল ডা. মোক্তাদির। সুন্নতে খতনা ছোট অপারেশন হওয়ায় তার কাছে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে কথা বলে খতনা করাতে ৫ হাজার টাকা ব্যয়ও নির্ধারণ করা হয়েছিল। অগাধ আস্থা ছিল ডা. মোক্তাদিরের ওপর। বারবার বারণ করেছিলাম ফুল অ্যানেসথেসিয়া দিতে। চিকিৎসকরা শুনেননি সেই কথা। তারা ফুল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে আমার মানিককে মেরে ফেলেছে। আমরা কোনো ক্ষতিপূরণ চাই না, সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে যারা মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তাদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসিতে অভিযোগ দেব। কিন্তু বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমরা দেখেছি ইউনাইটেডের ঘটনায় আয়ানের পরিবার কোনো প্রতিকার পায়নি, আমরা পাব বলে মনে হয় না। ডাক্তাররা কখনো আরেকজন ডাক্তারকে বিচারের মুখোমুখি করে না।
শোকের মাতম এখনো আয়ানের ঘরে
বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুল ছুটিতে বাবা শামীম আহমেদের হাত ধরে গত ৩০ ডিসেম্বর সাঁতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করতে আসে পাঁচ বছরের শিশু আয়ান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ৩১ ডিসেম্বর খতনা-পূর্ব অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়। এর আট দিন পরও জ্ঞান ফেরেনি আয়ানের। উন্নত চিকিৎসার জন্য গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে ৭ জানুয়ারি রাত ১১টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসায় ব্যয় ধরা হয় ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৭ টাকা। শিশু আয়ানের মৃত্যুর পরও এই বিলের টাকা দাবি করে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। একমাত্র পুত্রসন্তানকে হারিয়ে গত দেড় মাসেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি শামীম আহমেদ ও রেহানা আক্তার দম্পতি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরুনা গ্রামের বাড়িতে এখনো চলছে শোকের মাতম। বাড্ডা থানায় মামলা, উচ্চ আদালতে রিট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগের পরে হাসপাতাল বন্ধ হলেও সন্তান তো ফিরে আসেনি। উল্টো অচেনা নাম্বার থেকে ফোনে অনবরত হুমকি মিলছে শামীম আহমেদের। একমাত্র পুত্রহারা শামীম-রেহানা দম্পতির দিন কাটে এখন সন্তানের স্মৃতি আঁকড়ে। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের জন্য আইনি লড়াই চালাতে গিয়ে তিনি অনেকটা হতাশ।
গতকাল শুক্রবার কথা হয় আয়ানের বাবা শামীম আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভুল চিকিৎসায় সন্তান হারিয়ে ইউনাইটেডের মতো প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাতে আমি বিভিন্ন সময়ে হুমকি পেয়ে আসছি। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হওয়ায় পুলিশ ও স্বাস্থ্য প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে অসহযোগিতার শিকার হচ্ছে। ইউনাইটেড গ্রুপ নিজেদের প্রভাবে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছে। বিভিন্ন সময়ে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করে বলা হচ্ছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবে। এ ঘটনায় আমি থানায় জিডিও করেছি। সন্তান হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে আমি হতাশ। কিন্তু হাল ছাড়ব না। আমার তো আর হারানোর কিছু নেই। আমার একমাত্র মানিকই তো ওদের ভুলে হারিয়েছি। তিনি বলেন, আয়হামের ঘটনায় তো দোষীরা গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু আয়ানের মৃত্যুতে সংশ্লিষ্টরা এখনো ঘুরে বেরাচ্ছে। তারা প্রভাবশালী বলে আইনের বাইরে থেকে যাবে। আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিচার হলে আয়হামকে হয়তো হারাতে হতো না।