‘আমারে বদলি করতে মন্ত্রী লাগব, এমপি দিয়ে হবে না। মন্ত্রীর সুপারিশ লাগবে, প্লাস ডিজির ... লাগবে। কত উপজেলা চেয়ারম্যান কত কী কইরা লাইতাছে।’ এভাবেই ঔদ্ধত্যের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোহায়মিনুল ইসলাম। হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে এক সেবাগ্রহীতার অসন্তোষ প্রকাশের জেরে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
শুক্রবার বিকেলে সরেজমিন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখা যায়, সেখানে একজন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকায় ওয়ার্ডবয় কাউসার মিয়া রোগীর হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ করছেন। উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোহায়মিনুল ইসলাম তার টেবিলে বসে আছেন। সে সময় রোগীর সঙ্গে থাকা এক ব্যক্তি মোহায়মিনুল ইসলামের সঙ্গে হাসপাতালের চিকিৎসার ব্যাপারে তার অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয় বলে মন্তব্য করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উপরোক্ত মন্তব্য করেন মোহায়মিনুল ইসলাম।
এমন মন্তব্যের বিষয়ে কালবেলাকে মোহায়মিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এমপির কথা বলিনি, মন্ত্রীর কথা বলেছি। মন্তব্যটি কথার আলোকে এমনি মজা করেই বলেছি। উনি (সেবাগ্রহীতা) যেভাবে বলেছেন, উনার সঙ্গে এভাবেই হয়তোবা বলেছি।’
এদিকে একই দিন সকালে ১৪ মাস বয়সী শিশু মো. রমজান মিয়া পুকুরের পানিতে ডুবে যায়। পরিবারের লোকজন শিশুটিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ নিয়ে আসে। সেখান থেকে ইসিজি করার জন্য শিশুটিকে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। ইসিজি রিপোর্ট দেখে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মোহায়মিনুল ইসলাম শিশুটিকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। পরে তার স্বাক্ষরিত একটি ব্যবস্থাপত্র নিয়ে শিশুটির অভিভাবকরা মৃতদেহ নিয়ে চলে যান।
এ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য একজন সাংবাদিক দুপুরে হাসপাতালে যান। সে সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন ডা. মোন্তাসির মামুন হৃদয়। তাকে হাসপাতালে না পেয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সকালে শিশুমৃত্যুর বিষয়ে অবগত নই। ওই সময়ে ডা. শফিকুল ইসলাম জরুরি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন।’ তবে ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে অবগত নই। সকাল ৮টা পর্যন্ত আমি দায়িত্বে ছিলাম। ৮টার পরে ডা. মোন্তাসির দায়িত্বে ছিলেন।’ পরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অভিজিৎ রায়ের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনিও বিষয়টি জানেন না বলে জানান। পরে খোঁজ নিয়ে ডা. অভিজিৎ রায় ওই সাংবাদিককে বলেন, ‘ওই সময় ডা. মোন্তাসির দায়িত্বে ছিলেন। ডাক্তারের অজ্ঞাতসারে এমনটা হওয়ার কথা নয়। ডাক্তারের সেটা জানা থাকার কথা, ডাক্তার জানবে না কেন?’
পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের পরিচয় দিয়ে মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মাহমুদুল হাসান এই প্রতিবেদকের কাছে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ব্যাপারে কী কী অভিযোগ রয়েছে, তা জানতে চান। অভিযোগগুলো শোনার পর সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনটি করলে জেলার মান ক্ষুণ্ন হবে, আপনি একটু চিন্তা কইরা দেইখেন প্রতিবেদনটি করবেন কি না। এটা আপনার ওপর ছেড়ে দিলাম।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ২০০৭ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও বাস্তবে সেবার মানের কোনো উন্নতি হয়িনি। চিকিৎসকরা সময়মতো হাসপাতালে আসেন না, সময় শেষ হওয়ার আগেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান। ভর্তি রোগীদের পর্যাপ্ত সেবা দেওয়া হয় না। জরুরি বিভাগেও বেশিরভাগ সময়েই চিকিৎসক থাকেন না। ফলে পিয়ন, ঝাড়ুদার আর ওয়ার্ড বয়রাই ব্যান্ডেজ, সেলাইসহ বিভিন্ন অস্ত্রোপচার করে থাকেন। রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ এবং সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে অবহেলার মতো ঘটনাও অহরহ ঘটছে।
প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য রোগীদের পাঠানো হয় বিভিন্ন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। হাসপাতালের কর্মকর্তা এবং স্টোর কিপারের বিরুদ্ধে একটি বেসরকারি ক্লিনিকের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগও রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমি আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। আমি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলব। এসব অনিয়ম প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এগুলো নিয়ে আমি কাজ করব। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’