হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ট্রাম্পের সফরে কী পেল যুক্তরাষ্ট্র-এশিয়া

ট্রাম্পের সফরে কী পেল যুক্তরাষ্ট্র-এশিয়া

মার্কিন প্রেসিডেন্টদের বিদেশ সফর সাধারণত বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনের এক মঞ্চ হিসেবে দেখা হয়। সে অর্থে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এবারের পাঁচ দিনের পূর্ব এশিয়া সফর ছিল ব্যতিক্রম। এটি আমেরিকার নয়, ব্যক্তি ট্রাম্পের ক্ষমতার প্রদর্শন হয়েছে। পাশাপাশি তার সীমাবদ্ধতাও প্রকাশ পেয়েছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য-যুদ্ধের দামামার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার পাঁচ দিনের এশিয়া সফর শেষ করেন ৩০ অক্টোবর। ট্রাম্প এ সময় মালয়েশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন। এসব দেশে পেয়েছেন আতিথেয়তা, রাজার মতো সম্মান আর বিপুল পরিমাণ টাকাকড়ি, মানে বাণিজ্যচুক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা। তবে সেই ধারায় একেবারে ব্যতিক্রম ছিল চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠক। ৩০ অক্টোবর দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে যেন ট্রাম্পই দিলেন আতিথেয়তা! কারণ, এটি ছিল সমমর্যদার পরাশক্তির মুখোমুখি হওয়া। এরপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ বৈঠককে সফল বলে চীনা পণ্যে শুল্ক কমিয়েছেন। হয়েছে বহুল আলোচিত বিরল খনিজ চুক্তিও। ট্রাম্পের এ সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্ব এশিয়ার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে লিখেছেন হুমায়ূন কবির

যুক্তরাষ্ট্রে যখন ফেডারেল সরকারের অচলাবস্থা ও আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল, তখন হোয়াইট হাউস এ সফরটিকে তুলে ধরে ‘আমেরিকা ফার্স্ট কূটনীতি’ হিসেবে। এ নীতিতে ট্রাম্প শুল্ক বাড়ানোর হুমকি ব্যবহার করে মিত্র ও প্রতিপক্ষ উভয়ের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ছাড় আদায়ের চেষ্টা করেন।

এ সফরে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অঙ্গীকার পেয়েছে, রপ্তানির ওপর কিছু শুল্ক ছাড়ও নিশ্চিত হয় এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা কমে আসে। চীনের সঙ্গে সমঝোতাকে ট্রাম্প নিজেই ‘১০-এর মধ্যে ১২ নম্বর পাওয়ার’ সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, এগুলো মূলত সাময়িক কৌশলগত অর্জন, দীর্ঘমেয়াদে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন নয়। এটি শান্তি নয়, বরং সাময়িক বিরতি—বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মিত্ররা উদ্বিগ্ন হতে পারে।

ট্রাম্পের সফরসঙ্গী বিবিসির উত্তর আমেরিকা সংবাদদাতা অ্যান্থনি জুরখার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের বিদেশ সফর সাধারণত বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পাঁচ দিনের পূর্ব এশিয়া সফরও ছিল মূলত তার ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রদর্শন। তবে এবার একই সঙ্গে, সেই ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ, চীনের পাল্টা শুল্কের আঘাতে যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের সমঝোতা করতে এবং চীনকেও অনেক ছাড় দিতে বাধ্য হয়।

বিবিসির জুরখার লিখেছেন, প্রথম চার দিন মালয়েশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্পের সফর ছিল এমন এক কূটনৈতিক অনুশীলন, যেখানে সবাই চেষ্টা করছিল এক অস্থির ও অনিশ্চিত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে খুশি রাখতে। কারণ ট্রাম্প এক কলমের ছোঁয়ায় শুল্ক বা অন্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন, যা রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিগুলোর জন্য ভয়াবহ হতে পারে। তবে ৩০ অক্টোবর চীনের শির সঙ্গে তার বৈঠক ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এটি ছিল দুই সমমর্যাদার পরাশক্তির নেতার মুখোমুখি হওয়া। সেখানে দুই দেশের অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং নাগরিকদের কল্যাণ, সবকিছুরই বড় ঝুঁকি যুক্ত। চীনের ক্ষেত্রে ট্রাম্প কলম চালাতে পারেন, কিন্তু এর পরিণতিও আরও ভয়াবহ। প্রথম চার দিন সফর ছিল বেশ মসৃণ। প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল বাণিজ্য আলোচনা ও ট্রাম্পকে তুষ্ট করার এক প্রদর্শনী, যা অনেক সময় সীমা ছাড়িয়ে চাটুকারিতার পর্যায়ে পৌঁছায়।

মালয়েশিয়ায় ট্রাম্প গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার পান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির পথে অগ্রগতি করেন। পাশাপাশি তিনি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে এক ‘শান্তি চুক্তি’ তত্ত্বাবধান করেন, যা ট্রাম্প পছন্দ করেন দেখাতে। জাপানে ট্রাম্পের হেলিকপ্টার মেরিন ওয়ান টোকিও টাওয়ারের পাশ দিয়ে উড়ে যায়, যা সেদিন আমেরিকার পতাকার লাল-সাদা-নীলে আলোকিত ছিল, আর টাওয়ারের চূড়া ছিল সোনালি ‘ট্রাম্পীয়’ রঙে।

জাপানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সানাই তাকাইচি যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেন এবং দেশটির ২৫০ বার্ষিকী উপলক্ষে ট্রাম্পকে উপহার দেন ২৫০টি চেরি গাও প্রয়াত শিনজো আবের ব্যবহৃত গলফ ক্লাব ও ব্যাগ। তাকাইচি ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনয়ন দেন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্পকে রাজকীয়ভাবে স্বাগত জানানো হয়। কামান থেকে ২১ রাউন্ড গান স্যালুট, সামরিক ব্যান্ডে বাজানো হয় ‘হেইল টু দ্য চিফ’ এবং ট্রাম্পের প্রিয় সংগীত ওয়াইএমসিএ। প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং ট্রাম্পকে দেশের সর্বোচ্চ পদক ও এক প্রাচীন রাজবংশীয় মুকুটের প্রতিলিপি উপহার দেন। দুপুরের খাবারে পরিবেশন করা হয় ‘শান্তিদূতের মিষ্টান্ন’ সোনার প্রলেপ দেওয়া ব্রাউনি। পরে ছয়টি দেশের নেতাদের নিয়ে ট্রাম্পের সম্মানে নৈশভোজে পরিবেশন করা হয় বিশেষ ওয়াইন।

এবার এশিয়া সফরে ট্রাম্প ছিলেন সত্যিকার অর্থেই রাজাদের মতো সম্মানিত। আর রাজাদের মতোই ট্রাম্পও এসেছিলেন ‘কর’ নিতে- দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থপ্রদান (প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন ডলার), যা যুক্তরাষ্ট্রের তহবিলে যাবে। এর বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানিতে মার্কিন শুল্ক ২৫ ভাগ থেকে কমে ১৫ ভাগ করা হয়।

কিন্তু সফরের মূল আকর্ষণ ছিল চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে শেষ বৈঠক। এখানে আগের রাজকীয় আড়ম্বরের কিছুই ছিল না—না ব্যান্ড, না অভ্যর্থনা। বরং বুসান বিমানবন্দরের পাশে এক সাধারণ সামরিক ভবনে দীর্ঘ টেবিলের দুই পাশে বসেছিলেন দুই নেতা ও তাদের উপদেষ্টারা।

ট্রাম্পের মুখে তখন টানটান ভাব— এক দিন আগেও তিনি বলেছিলেন, আমি বেশ আশাবাদী, ভালো বৈঠক হবে। তবে এর পেছনে ছিল মাসের পর মাসের উত্তেজনা। ট্রাম্প চীনকে উচ্চ শুল্কের হুমকি দিচ্ছিলেন, চীনা বাজার খুলে দিতে ও ফেন্টানিল তৈরির রাসায়নিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে চাপ দিতে। চীন পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়, আমেরিকার কৃষিপণ্য কেনা স্থগিত করে এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রস্তাব দেয়।

শেষে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দুপক্ষ সমঝোতায় আসে— আমেরিকা শুল্ক কমাবে, চীন আবার কৃষিপণ্য আমদানি শুরু করবে, তেল ও গ্যাস কেনা বাড়াবে এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজে প্রবেশাধিকার দেবে। যদিও এটি কোনো যুগান্তকারী চুক্তি নয়, তবে একে উভয়পক্ষের বাস্তবতা স্বীকার বলে দেখা হচ্ছে।

শি বৈঠকের শুরুতে বলেন, বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে মতপার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। এটি হয়তো কিছুটা ইতিবাচক ইঙ্গিত, কিন্তু একই সঙ্গে জানিয়ে দেয় যে সংঘাত, এখানেই শেষ নয়। চীন তার বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াতে চায়, আর ট্রাম্প আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করছেন—যেখানে মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বী উভয়কেই চাপ দিয়ে রাখা হয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী মিত্ররা নতুন বাস্তবতায় নিজেদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ট্রাম্পকে খুশি রাখতে নানা রকম উপহার ও সম্মান দিচ্ছে। কিন্তু বড় আর্থিক দায়, বাড়তি প্রতিরক্ষা ব্যয় ও স্থায়ী শুল্কের বোঝা তাদের ভাবিয়ে তুলছে। শেষ পর্যন্ত এসবই আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা চীনের জন্য সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এক ধরনের সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা। মিত্ররা শুল্ক এড়াতে আপস করেছে, আর শি জিনপিং কিছু না হারিয়েই বাড়তি সময় পেলেন। তাই বলা যায়, বাণিজ্যযুদ্ধ থামেনি—এটি কেবল এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নিচ্ছে।

তবে ট্রাম্পের এশিয়া সফর তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ভাবমূর্তিকে শক্ত করেছে। তার জন্য রাজনৈতিকভাবে বড় সাফল্য বয়ে এনেছে। এক ট্রিলিয়নেরও বেশি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি তার ‘দক্ষ আলোচক’ ভাবমূর্তিকেও শক্ত করেছে এবং কৃষকদের অসন্তোষ প্রশমিত করেছে। তবে এ চীনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি আসলে একটি কৌশলগত বিরাম, স্থায়ী শান্তি নয়। যুক্তরাষ্ট্র সাময়িক স্বস্তি ও আর্থিক লাভ পেলেও প্রযুক্তি, তাইওয়ান ও বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মারা গেলেন ইরফান পাঠান-আম্বাতি রাইডুদের সাবেক সতীর্থ

দুই ভাইকে হত্যার ঘটনায় মামলা, গ্রেপ্তার ৩

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ ঢাকার

ফের জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান

আপিল বিভাগের শুনানি পর্যবেক্ষণে নেপালের প্রধান বিচারপতি

ইনুর বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ ট্রাইব্যুনালের

৩১ দফা বাস্তবায়ন অপরিহার্য : অপু

সড়কের কাজ ফেলে লাপাত্তা ঠিকাদার

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্যাম্পেইন শুরু

স্মিথকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড ঘোষণা

১০

পাকিস্তান কি গোপনে ভয়ংকর কোনো অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে?

১১

সাভারে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১২

ক্যারিয়ারে প্রথম ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জিতলেন এমবাপ্পে

১৩

ছেলের লাঠির আঘাতে প্রাণ গেল বাবার

১৪

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় যুবক উদ্ধার

১৫

বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় যুবকের কাণ্ড

১৬

নেপালে এভারেস্টের পাদদেশে আটকা শতাধিক পর্যটক

১৭

রেস্টুরেন্ট স্বাদের অরেঞ্জ চিকেন রেসিপি এখন আপনার রান্নাঘরেই

১৮

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে শফিক তুহিনের গান ‘মানবতার জয় হোক’

১৯

বাংলাদেশের পরবর্তী সিরিজ কবে কখন, দেখে নিন পূর্ণাঙ্গ সূচি

২০
X