কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৫৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিপদেও মুমিনের জন্য কল্যাণ থাকে

মাওলানা মাহবুবুর রহমান
বিপদেও মুমিনের জন্য কল্যাণ থাকে

স্বর্ণ আগুনে পোড়ালে যেমন অমূল্য অলংকার হয়ে ওঠে, তেমনি মুমিন বান্দা বিপদ-আপদে জান্নাতের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। মুমিন যখন রোগ-শোকে ভোগে, বিপদে পতিত হয়, হয়তো সে জানে না, আল্লাহ তার ওপর পতিত হওয়া বিপদের মাধ্যমে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দিচ্ছেন। কিংবা তার পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে, তার সবর ও শোকর দেখে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে উত্তম বিনিময় দান করবেন। আল্লাহ স্বয়ং তার বান্দার জন্য যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন তা কল্যাণ ছাড়া আর কীই বা বয়ে আনতে পারে? হয়তো বান্দার সাময়িক কষ্ট হয়, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির মতো বিশাল অর্জন সে করে ফেলতে পারে এক নিমেষেই। শুধু আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করে। আর আল্লাহ তো ধৈর্য ধারণকারীদের সঙ্গেই আছেন।

পৃথিবীতে সব মানুষের জীবনেই আসে সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনা। তবে এই সুখ ও আনন্দ, এই দুঃখ ও বেদনার মাধ্যমেও একজন মুমিন অর্জন করতে পারেন পার্থিব তৃপ্তি, পরকালীন পুরস্কার ও মহান আল্লাহর নৈকট্য। কারণ মুমিনের সুখেও কল্যাণ, দুঃখেও কল্যাণ। মুমিনের পুরোটা জীবনই কল্যাণময়। সাহাবি সুহাইব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের বিষয় বড়ই আশ্চর্যজনক। সবকিছুই তার জন্য কল্যাণবহ; মুমিন ছাড়া আর কারও এ বৈশিষ্ট্য নেই। মুমিন যখন আনন্দদায়ক কিছুর মুখোমুখি হয়, তখন সে শোকর করে; আর শোকর তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। যখন কষ্টদায়ক কিছুর সম্মুখীন হয়, তখন সে সবর করে, আর সবরও তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৯৯৯)। অর্থাৎ, মুমিন যখন আনন্দে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তখন সে এর বিনিময়ে পুণ্য অর্জন করে। একইভাবে যখন সে কষ্টে আল্লাহর জন্য ধৈর্যধারণ করে, তখন সে এর বিনিময়ে পুণ্য অর্জন করে। মুমিনের শোকর ও সবর, কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্যধারণ উভয়টির মাধ্যমেই সে অর্জন করে পুণ্য এবং রবের নৈকট্য। ফলে মুমিনের জীবনে ইতিবাচক-নেতিবাচক যাই আসে, এর বিনিময়ে সে সমৃদ্ধ হয়। যেহেতু সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনুষঙ্গ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না, তাই আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর সবসময় শোকর ও সবরের অনুভূতিতে পরিপূর্ণ থাকে।

মুমিন জীবনে অকল্যাণকর কিছুই নেই। দুঃখ-দুর্দশা, বিপদ-আপদ, সবকিছুতেই যদি বান্দা ধৈর্য ধারণ করে, তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া হতে তাকে আর কিছুই বিরত করতে পারে না। বান্দার জন্য আল্লাহর বাছাই করা সিদ্ধান্ত, চাই তা যত কঠিনই হোক না কেন, বান্দা যদি খুশিমনে সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়, সবর রাখে আর আল্লাহর জিকিরে নিজের জীবনকে রাঙিয়ে নেয়, তবে তা তার মুক্তির জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। পার্থিব অজস্র কল্যাণ তো তার ওপর বর্ষিত হয়ই, আখেরাতও তার জন্য সহজ হয়ে যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তার দেওয়া নেয়ামতের ব্যাপারে বান্দাকে পরীক্ষা করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর বণ্টনে সন্তুষ্ট হয়, আল্লাহ তার নেয়ামতে আরও বরকত ও প্রশস্ততা দান করেন। আর যে অসন্তুষ্ট হয়, আল্লাহ তার নেয়ামতে বরকত দেন না।’ (তিরমিজি: ২৩৬৯)। এই সৌভাগ্য শুধু ওইসব ইমানদারেরই ভাগ্য, যারা মহান আল্লাহর সঙ্গে এমন ইমানি সম্পর্ক স্থাপন করে নিয়েছেন যে, সব সুখ ও আনন্দ, সব প্রাপ্তি ও অর্জন তারা আল্লাহর দান মনে করেন এবং আল্লাহর শোকর আদায় করেন। আর তারা যদি দুঃখ-বেদনা, বিপদ ও দুর্দশায় আপতিত হন, তখন তারা মহান রবের পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করে পুরস্কারের আশায় সবর ও ধৈর্য অবলম্বন করেন।

মহান আল্লাহ মাঝেমধ্যে তার প্রিয় বান্দাদের বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন, যারা বিপদে ধৈর্য ধারণ করে, মহান আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)। সব ক্ষেত্রে বিপদে পড়ার মানে এই নয় যে, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিটি আল্লাহর অপ্রিয়। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের আরও বেশি পরীক্ষা করেন। তাদের পুরস্কার যেমন বড়, বিপদও তেমন বড়। এটা নবীজির বাণী। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমি নবীজির (সা.) কাছে গেলাম, তখন তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। আমি তার ওপর আমার হাত রাখলে তার গায়ের চাদরের ওপর থেকেই তার দেহের প্রচণ্ড তাপ অনুভব করলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কত তীব্র জ্বর আপনার। তিনি বলেন, আমাদের (নবী-রাসুলগণের) অবস্থা এমনই হয়ে থাকে। আমাদের ওপর দ্বিগুণ বিপদ আসে এবং দ্বিগুণ পুরস্কারও দেওয়া হয়। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কার ওপর সর্বাধিক কঠিন বিপদ আসে? তিনি বলেন, নবীগণের ওপর। আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তারপর কার ওপর? তিনি বলেন, তারপর নেককার বান্দাদের ওপর। তাদের কেউ এতটা দারিদ্র্যপীড়িত হয় যে, শেষ পর্যন্ত তার কাছে তার পরিধানের কম্বলটি ছাড়া কিছুই থাকে না। তাদের কেউ বিপদে এত শান্ত ও উৎফুল্ল থাকে, যেমন তোমাদের কেউ ধন-সম্পদপ্রাপ্তিতে আনন্দিত হয়ে থাকে।’ (ইবনে মাজা, হাদিস: ৪০২৪)

বিপদ-মুসিবত কখনো কখনো মানুষের গুনাহ মাফেও সহযোগী হয়। বান্দার ওপর বিপদ এলে সে যদি আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে ধৈর্য ধরে, তখন তা তার গুনাহ মাফে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ছোট থেকে ছোট বিপদও মুমিনের গুনাহ মাফে সহায়ক হয়। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফোঁটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (বোখারি, হাদিস: ৫৬৪২)। তাই মুমিনের কর্তব্য, বিপদের দিনে ভেঙে না পড়ে মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা ও আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। ইনশাআল্লাহ মহান আল্লাহ দুশ্চিন্তাকে আনন্দে পরিণত করবেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের দৃষ্টান্ত হলো নরম কোমল শস্যের মতো। বাতাস যেদিকে দোলা দেয়, শস্যের পাতা সেদিকেই দুলতে থাকে। বাতাস থেমে গেলে স্থির হয়ে যায়। মুমিনও তেমনি বিভিন্ন আপদ-বিপদ দিয়ে তাকে দোলা দেওয়া হয়। আর কাফিরের দৃষ্টান্ত হলো দেবদারু গাছের মতো। দৃঢ় স্থির (বাতাস তাকে টলাতে পারে না) অবশেষে আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন তাকে মূলোৎপাটন করে দেন।’ (বোখারি, হাদিস: ৭৪৬৬)।

মোট কথা, পৃথিবীর জীবনে সময়ে সময়ে মুমিনের ওপর বিভিন্ন বিপদ-মুসিবত, রোগ-শোক, কষ্ট-ক্লেশ ইত্যাদি এসে থাকে। এসব পরিস্থিতির মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রভূত কল্যাণ এবং বিশেষ দয়া ও রহমত লাভ করে থাকে। এতে তার গুনাহ মাফ হয়। আল্লাহর কাছে তার অবস্থান উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে থাকে। অতএব, মুমিনের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। যে ব্যক্তি মহান রবের প্রতি বিশ্বাস ও ভরসা রাখে, আশা ও ভালোবাসা হৃদয়ে ধারণ করে, সে কীভাবে হতাশ বা নিরাশ হতে পারে? সামান্য ঝড়ের ঝাপটায় কীভাবে তার হৃদয়ের শিকড়ে টান পড়তে পারে? যখন সে জানে আল্লাহ তার রব এই পুরো বিশ্বজগৎ মুমিনের খেদমতে নিয়োজিত, জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত আসছে তার মহামহিম রবের কাছ থেকে; তথাপি আল্লাহ তার জন্য উৎকৃষ্ট রিজিক দিচ্ছেন, তাকে প্রতিপালন করছেন, কখনো পরীক্ষা করছেন, কখনো নেয়ামতের সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছেন; মুমিনের কল্যাণের জন্য আর কী চাই? সুতরাং হতাশা ঝেড়ে ফেলে আমাদের মনে দৃঢ় ধারণা রাখতে হবে, আল্লাহ বান্দার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধান্তটাই নিয়েছেন। পরম ভালোবেসে, শোকর করে, আল্লাহর ওপর চোখ বুজে ভরসা করে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যায়, তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর ভালোবাসা পাওয়া থেকে আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না। আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)।

মহান আল্লাহ সবাইকে বোঝার এবং এ অনুযায়ী জীবন সাজানোর তওফিক দিন।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যেভাবে মিলবে টানা ১৬ দিনের ছুটি

পকেটে দীর্ঘক্ষণ মোবাইল রাখলে কি পুরুষের শুক্রাণু কমে যায়? 

ফ্যাসিবাদের দালালি করা গণমাধ্যম টিকে থাকার অধিকার রাখে না : রিজভী

ইসরায়েলের সঙ্গে তৃতীয় অস্ত্রচুক্তি বাতিল করল স্পেন

হাসিনার ষড়যন্ত্র রুখতে পূজামণ্ডপ পাহারা দেবে বিএনপি : সরওয়ার 

পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে কেওক্রাডং

এনসিএলে সিলেট চট্টগ্রামের জয়

ডাকসু নির্বাচনে দায়িত্বে থেকেও অনিয়মের অভিযোগ সাদা দলের দ্বিচারিতা : ইউটিএল

নেতানিয়াহুর ভাষণে জাতিসংঘে প্রতিক্রিয়া দেখালেন ইসরায়েলি সেনার বাবা

নবীজির (সা.) প্রিয় ফল কী ছিল, জেনে নিন

১০

মরদেহ সৎকারে গিয়ে নৌকাডুবিতে একজনের মৃত্যু, নিখোঁজ ২

১১

১২ দলীয় জোট / নির্বাচন ও জুলাই সনদ নিয়ে কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক

১২

কবজিবিহীন হাত দিয়ে ঘুষি মেরে ইট-পাথর ভাঙেন শামীম

১৩

গ্রিন ডট লিমিটেডের স্নাকি নাইট অনুষ্ঠিত

১৪

এবার খাগড়াছড়িতে ৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

১৫

গোপালগঞ্জে বাস-ইজিবাইক সংঘর্ষ, নিহত বেড়ে চার

১৬

দুর্গাপূজা উপলক্ষে মুন্সীগঞ্জে বাংলাদেশ সনাতন পার্টির বস্ত্র বিতরণ

১৭

৩০তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ফোরামের এডহক কমিটি গঠন

১৮

নাইজেরিয়ায় স্বর্ণখনিতে ভয়াবহ ধস, বহু প্রাণহানির শঙ্কা

১৯

রাজধানীতে বগুড়া থিয়েটার পরিবার ঢাকার অভিষেক অনুষ্ঠিত

২০
X