প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৩, ০২:৩০ এএম
আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২৩, ০৯:২৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আন্দোলন নিয়ে উভয় সংকটে বিএনপি

আন্দোলন নিয়ে উভয় সংকটে বিএনপি

টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এখন যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি থেকে সরে এসে তারা এখন সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে। বিরোধী দল সরকার পতনের আন্দোলন করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে একটা কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, বিএনপির দাবি মেনে এখন যদি আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে, তাহলে কারা ক্ষমতায় আসবে, কাদের অধীনে নির্বাচন হবে? বিএনপি যদি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটা রূপরেখা ঘোষণা করত, তাহলে সবার জন্য বুঝতে সুবিধা হতো, আসলে তারা কী চায়।

তবে এটা মানতেই হবে গত ১৭ বছরে এই প্রথম বিএনপি সুপরিকল্পিতভাবে, সতর্কতার সঙ্গে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। গত ১২ জুলাই সরকার পতনের একদফা ঘোষণার পর থেকেই নানা কর্মসূচিতে মাঠে থাকার চেষ্টা করছে বিএনপি। এসব কর্মসূচিতে দলীয় নেতাকর্মীদের বাইরে সাধারণ মানুষের বিপুল উপস্থিতি তাদের নিশ্চয়ই আত্মবিশ্বাসী করবে। তবে বিএনপির কর্মসূচিতে লোকসমাগম বাড়ার কিছুটা কৃতিত্ব আওয়ামী লীগকে, অনেকটা কৃতিত্ব সরকারকে দিতে হবে। বিএনপি কোনো কর্মসূচি দিলেই আওয়ামী লীগ পাল্টা একটা কর্মসূচি দেয়। তাতে এক ধরনের পাল্টাপাল্টি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি মানুষকে আরও বেশি আন্দোলনমুখী করে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার কারণেই হোক বা নিজেদের উপলব্ধি থেকেই হোক; সরকার এখন অনেক বেশি সহনশীল। আন্দোলনে বিএনপির পাশে মাঠে থাকলেও বড় কোনো সংঘর্ষের ঘটনা এখন ঘটেনি। আগে বিএনপির বড় কোনো কর্মসূচি থাকলে সরকার ও সরকারি দল নানাভাবে তাতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত। ধরপাকড়, মামলা-হামলা, পরিবহন ধর্মঘট ডাকা, যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া, আতঙ্ক সৃষ্টি করে মানুষকে কর্মসূচিতে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করত। এখনো ধরপাকড়, মামলা, রাস্তায় রাস্তায় তল্লাশির ঘটনা ঘটছে। তবে আগের তুলনায় অনেক কম। সে কারণেও বিএনপির বিভিন্ন সমাবেশে লোকসমাগম বাড়ছে। বিএনপির সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই, তাদের আন্দোলন করার সক্ষমতা নেই, কোন ঈদের পর আন্দোলন—এসব বলে যারা বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন; তারা এখন নিশ্চয়ই তাদের কথা ফিরিয়ে নেবেন। গত ১২ জুলাই একদফা ঘোষণার পর থেকে বিএনপি খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে আন্দোলন এগিয়ে নিচ্ছে। তবে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াও যেমন মুশকিল, আবার আন্দোলনের গতি একবার থেমে গেলে তা আবার টেনে তোলাও মুশকিল। তাই আন্দোলনের এ ভারসাম্যটা মাথায় রেখেই কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। যেমন, গত বছর বিএনপি অপ্রয়োজনে দেশজুড়ে বিভাগীয় সমাবেশ করে শক্তিক্ষয় করেছে। সংঘর্ষে জড়িয়ে রক্তক্ষয়ও হয়েছে। গত বছরের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অনেক মামলা হয়েছে। সরকার নিশ্চয়ই সময়মতো সে মামলাগুলো চাঙ্গা করবে। আমার বিবেচনায় গত বছরের আন্দোলন থেকে অনেক মামলা ছাড়া বিএনপির কোনো প্রাপ্তি নেই। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির এবার জীবন-মরণপণ। এবার তাই আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে ১২ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিএনপি যেভাবে একের পর এক কর্মসূচি দিয়েছে, তাতে যথেষ্ট লোকসমাগম হলেও নেতাকর্মীদের তা ক্লান্তও করেছে। তাছাড়া গত শনিবারের রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচির ব্যর্থতা কর্মীদের মনে ভিন্ন বার্তা দেবে। শুক্রবারের মহাসমাবেশের পরদিনই অবস্থান কর্মসূচির মতো কঠিন কর্মসূচির জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি তাদের ছিল বলে মনে হয়নি। বিএনপি হয়তো চেয়েছিল আগের দিন সমাবেশে যারা এসেছিল, তাদের দিয়েই অবস্থান কর্মসূচি সফল করে ফেলতে। কিন্তু মহাসমাবেশে যোগ দিতে যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন, তারা কয়েক দিন ধরেই এখানে সেখানে থাকছেন। ঢাকার নেতাকর্মীরাও মহাসমাবেশ আয়োজনে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত ছিলেন। তাই আগের দিন মহাসমাবেশে বিপুল লোকসমাগম হলেও পরদিনের অবস্থানে নেতাকর্মীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। গয়েশ্বর রায় ও আমানউল্লাহ আমানের অংশটুকু বাদ দিলে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে দেখা যায়নি প্রায়। অথচ কে কোথায় থাকবেন, তার তালিকা আগের দিনই গণমাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত নেতারা কেন নির্ধারিত স্থানে যাননি, তার জবাবদিহি কি চাইবে দল? গয়েশ্বর ও আমান পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে বা পুলিশি হামলার শিকার হয়ে অবস্থান কর্মসূচি সাফল্যের আবরণ দিলেও, গণমাধ্যমে বিপুল কভারেজ পেলেও মাঠের বিবেচনায় সেটি ছিল ব্যর্থ। এখন জানা যাচ্ছে, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলোকে অবস্থান কর্মসূচির ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। এমনকি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অনেকেও নাকি অবস্থান কর্মসূচির ব্যাপারে কিছু জানতেন না। আন্দোলনকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এ ধরনের হঠকারিতা ও সমন্বয়হীনতার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে সহিংসতার ব্যাপারে। আন্দোলনে লোকসমাগম যত বাড়বে, তার ওপর দলের নিয়ন্ত্রণও তত কমবে। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা যাতে সহিংস কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে, সেটা লক্ষ রাখতে হবে। এটা খুব সহজ নয়। লাখো মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ নয়। এটা বিএনপির ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও সত্যি। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের শেষবেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলা তো আওয়ামী লীগের লোকজনই চালিয়েছে। কিন্তু এই এক হামলা আওয়ামী লীগকে কতটা বিপাকে ফেলেছে, তা আওয়ামী লীগের সেই অতি উৎসাহী হামলাকারীরা কোনো দিন বুঝতেই পারবে না। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই হিরো আলমের ওপর হামলার নির্দেশ দেয়নি। তেমনি বিএনপিও এখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অঙ্গীকার করে মাঠে আছে। কিন্তু তাদের সতর্ক থাকতে হবে অতি উৎসাহী সমর্থকদের ব্যাপারে। শনিবার অবস্থান কর্মসূচির ব্যাপারে পুলিশের অনুমতি ছিল না। তারপরও বিএনপির কিছু নেতাকর্মী মাঠে ছিল। সেদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তাতে ফিরে এসেছে ২০১৪-১৫ সালের ভয়াবহ আগুন সন্ত্রাসের স্মৃতি। কারা বাসে আগুন দিয়েছে, তা এখনো প্রমাণিত নয়। কিন্তু যেহেতু বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি ছিল। তাই দায় তাদের নিতে হবে। আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে অগ্নিসন্ত্রাসের অভিযোগ এনে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। যে ভিসা নীতি আওয়ামী লীগকে কিছুটা সংযত করেছে, সেই ভিসা নীতি বিএনপির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তাই বিরোধী দলকে আন্দোলনের সময়ও কিন্তু শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাটা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের আন্দোলনে গেলে বিএনপিকে কিন্তু পশ্চিমাদের সহানুভূতি হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে। সেই ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা এখন বিএনপির নেই। বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশের ওপর এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমাদের কঠোর নজর। তাই সরকারি দলের ভূমিকা যেমন, বিরোধী দলের ভূমিকাও তারা আতশকাচে পর্যবেক্ষণ করছে। তাই কারোই এদিক-সেদিক করার সুযোগ নেই। তাই তো অবস্থান কর্মসূচি সকালে উত্তপ্ত থাকলেও দুপুরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আমানউল্লাহ আমানের হাসপাতালে খাবার পাঠান প্রধানমন্ত্রী। আর গয়েশ্বরকে সোনারগাঁও থেকে লাঞ্চ এনে খাওয়ান ডিবিপ্রধান।

আওয়ামী লীগ অভিযোগ করছে, বিএনপি বাসে আগুন দিয়ে আবার অগ্নিসন্ত্রাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশকে। আর বিএনপির দাবি, তারা আগুন দেয়নি। তৃতীয়পক্ষ আগুন দিয়ে তাদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে। তবে এখন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যতটা সজাগ; তাতে কারও ওপর দায় চাপানো মুশকিল। আর নজর আছে পশ্চিমাদেরও।

সরকার পতনের ব্যাপারে মরিয়া বিএনপি এবার তাদের আন্দোলন লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। তবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়েই সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে। বিদেশিরা তো বটেই, বাংলাদেশের মানুষও আর হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও, পোড়াও সমর্থন করবে না। তাই বিএনপির আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন বজায় রাখতে হলেও তাদের সতর্ক থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে লক্ষ্য অর্জন কতটা সম্ভব, সেটা যেমন বিবেচ্য আবার সহিংসতায় দেশি-বিদেশি সমর্থন হারানোর ঝুঁকিও থাকছে। তাই আন্দোলন নিয়ে উভয় সংকটে থাকা বিএনপিকে সামনের দিনগুলোতে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ইরাক

ইরানে ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত

ঘাটাইলে শিশু ধর্ষণের অভিযোগ, মামলা করায় হুমকি

শৌচাগারে ঢুকে মাদ্রাসাছাত্রের আত্মহত্যা

ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে গুপ্ত হত্যার চেষ্টা করছে ইরান, অভিযোগ ইসরায়েলের

বিএসআরএফের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত 

দ্বিতীয় ম্যাচেও অনিশ্চিত এমবাপ্পে

নাটোরে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত ৪

ম্যানসিটিকে ১৭ কোটি টাকা জরিমানা

অন্যের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কথা বললেও নিজের বেলায় মুখে কুলুপ ইসরায়েলের

১০

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সমাধান জানালেন পুতিন

১১

বেরোবি শিক্ষক মাহমুদুল গ্রেপ্তার, শিক্ষক-সাংবাদিকদের উদ্বেগ

১২

জামায়াতে ইসলামী প্রতিশোধের রাজনীতি করে না : বুলবুল

১৩

ঢাকার ডিএনসিসিতে শুরু হলো ফুটবল টুর্নামেন্ট 

১৪

অবশেষে ঢাকার জেলা জজ বদলি

১৫

আমেরিকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ইসরায়েল

১৬

সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়াল ইউরোপের ৯ দেশ

১৭

কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে অবনতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের

১৮

প্রথম সেশনে বাংলাদেশকে অলআউট করে ম্যাচ জিততে চায় লঙ্কানরা

১৯

এবার স্থানীয় নির্বাচনের জন্য জামায়াতের প্রার্থী ঘোষণা

২০
X