অ্যান্ড্রু মিত্রোভিকা
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রেসিডেন্ট ইউন অভ্যুত্থানে ব্যর্থ হলেন কেন

প্রেসিডেন্ট ইউন অভ্যুত্থানে ব্যর্থ হলেন কেন

ওয়াশিংটন ডিসি থেকে সিউল—পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতেই দক্ষিণ কোরিয়ায় অকস্মাৎ সামরিক আইন জারি করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। সামরিক আইন কেন্দ্র করে দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। তথাকথিত ভাষ্যকাররা বলছেন, নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইউন অতীতের শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অন্যান্য গতানুগতিক বিশ্লেষণের মতো এ বিশ্লেষণও সম্পূর্ণ সঠিক নয়।

ইউনের এ স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু ছোট-বড় কারণ। দেশটির সামরিক বাহিনীও ঐতিহাসিকভাবে গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ করে আসছে। তাই ইউনের এ সিদ্ধান্তে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল বলে অনেকে দাবি করছেন। এ কথা সত্য যে, সংসদের বিরোধিতা এবং বিচার বিভাগীয় প্রতিবন্ধকতা এড়াতে তিনি এমনটা করেছেন। ইউনের সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড এবং কৌশলী পদক্ষেপ সবাইকেই বিচলিত করেছে। কিন্তু এমন পদক্ষেপের পেছনে মূল কারণ হিসেবে যে মানুষ অতীতের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে চিহ্নিত করছে, তা নিতান্তই ভুল।

স্বৈরতন্ত্রের প্রচলন বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতীতে একনায়করা যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের সমর্থন আদায় করতেন, বর্তমানকালের একনায়করা একইভাবে জনসাধারণের অনুমোদন বাগিয়ে নিচ্ছেন। তারা দাবি করছেন যে, তাদের কাছে বিশ্বের জটিল সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান রয়েছে। তাদের নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের বড় একটা অংশ তাদের প্রতারণামূলক আশার বাণীর শিকার হয়। তারা এসব নেতার অযৌক্তিক কিন্তু সহজ বাচ্যে প্রণোদিত হয়। দেখতে শুরু করে তাদের রক্ষাকর্তার রূপে। আইনের শাসন, রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা, সংবাদপত্র এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা—এসবই যেন প্রাণপ্রিয় নেতার কাজের উপদ্রব! কমিউনিস্ট এবং অন্য শত্রুরা যারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট ও ক্ষতি করতে চায়, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় যেন এগুলো অপ্রয়োজনীয় বাধা সৃষ্টি করছে বলে প্রতীয়মান হয় তাদের কাছে।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইউন ঘোষণা দেন, তিনি সেনা মোতায়েন করছেন। যে কোনো স্বৈরশাসকের অভ্যুত্থান পরিচালনার এটা প্রথম ধাপ। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সামরিক বাহিনীর ব্যবহার জনসাধারণের মধ্যে ভীতির উদ্রেক ঘটায়। এমনটা করার পেছনে ইউনের উদ্দেশ্য তার বিরোধীদের দমন করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আটক করা। তার এ পরিকল্পনা সফল হলে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকরা স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থার অধীন হতে বাধ্য হতো। এ কাজ করে ইতিহাসব্যাপী অনেক দেশে অনেক ক্ষমতালোভী শাসক রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোকে নিজের বশে নেওয়ার প্রয়াস চালিয়েছে। সফলও হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। এভাবে তারা প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতি চর্চা করেছে। সক্ষম হয়েছে ক্ষমতায় বহাল থাকতে।

সম্প্রতি যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা গ্রাস করার অভিলাষ আরও একজন নেতার মধ্যে দেখা গেছে— তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমার ধারণা, প্রেসিডেন্ট ইউন যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অবলোকন করার চেষ্টা করেছেন, তখন তিনি নিজের ভেতর তাকেই দেখতে পেয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো তিনিও এক কট্টর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্পের মতো ইউন নিজেকে এক নির্দোষ মানুষ হিসেবে দেখেন, যিনি কি না বহুবিস্তৃত চক্রান্তের শিকার। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে তাই তিনি আদর্শ বলে মনে করছেন।

অসদাচরণের পরিণাম এবং বিচার বিভাগ কর্তৃক অপরাধের সাজার থেকে ট্রাম্পের মুক্তি পাওয়ার দুটো বড় কারণ হলো—রিপাবলিকানদের নিয়োগপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা এবং দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়লাভ। ট্রাম্প যেভাবে রাজনৈতিক মুক্তির নীলনকশা তৈরি করে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন, ইউনও এমনটা করতে চেয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের ওপর যে রাজনৈতিক চাপ ছিল, তা তিনি কৌশলগতভাবে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। ইউনও সেই কৌশল অবলম্বন করতে চাচ্ছিলেন বলে মনে হচ্ছে। বহুত্ববাদ, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন সংবাদ ও গণমাধ্যম—গণতন্ত্রের এসব ভিত্তির ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলা চালিয়েছেন। এমনকি তিনি তার উদ্দেশ্য হাসিলে সফলও হয়েছেন। ইউনেরও তাই মনে হয়েছিল যে, দক্ষিণ কোরিয়ায় একই পদ্ধতি অবলম্বন করে তিনিও তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবেন।

ট্রাম্প জনগণের মনে এই বিশ্বাস তৈরি করেছেন, আমেরিকার সরকারের বড় একটা অংশ গোপনে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ এবং তারা স্বাধীনতার নামে নাগরিকদের সঙ্গে অন্যায় করছে। আমেরিকার মাহাত্ম্য, শ্বেতাঙ্গদের জাতিগত আধিপত্য এবং খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় পবিত্রতা—সবই যেন ব্যাহত হচ্ছে এ দেশদ্রোহী সরকারি কর্মচারীদের কর্মকাণ্ড এবং ডেমোক্র্যাট রাজনীতিবিদদের কর্মসূচির কারণে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের যেসব কর্মচারী ট্রাম্পকে দোষী প্রমাণিত করার চেষ্টা করেছেন, তাদের সবার বিরুদ্ধে তিনি কঠিন ব্যবস্থা নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তারা দাবি করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও রাষ্ট্রের সংহতি—দুটিই ট্রাম্পের রাজনীতির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর পাল্টা জবাবে ট্রাম্পের ফ্যাসিস্ট কর্মপরিকল্পনা ইউনকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি সামরিক আইন জারি করেছেন।

অন্যদিকে আরও একজন নেতা, ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও কোনো ধরনের শাস্তির সম্মুখীন না হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তার নির্দেশেই ওয়েস্ট ব্যাংকের দখল নিয়েছে ইসরায়েলি সেনাসদস্যরা। তার নির্দেশেই গাজায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গণহত্যা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। এ বর্বরতার শিকার হচ্ছে অসংখ্য নারী ও শিশু। জীবন গেছে ৪৪ হাজার ফিলিস্তিনির। তবুও এখনো কোনো সাজার সম্মুখীন হতে হয়নি এই একনায়ককে। এ ঘটনাও ইউনের মনে সামরিক ক্ষমতাচর্চা করার সাহস জুগিয়েছে। তিনি চিন্তা করেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারপ্রধানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, সেহেতু দূরপ্রাচ্যেও যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের সরকারপ্রধানকে সমর্থন দেবে। কিন্তু তার এ ধারণা শিগগিরই ভুল প্রমাণিত হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার সাহসী সংসদ সদস্যরা অতিসত্বর সংসদ ভবন ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেন, যেন ইউনের পাঠানো সেনাসদস্যরা ভবনে প্রবেশ করতে না পারে। তারপর তারা সর্বসম্মত হয়ে প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। পাশাপাশি সামরিক আদেশ প্রত্যাহার করতে তাকে অনুরোধ জানান সবাই। এরই মধ্যে গণতন্ত্র পুনর্বহাল করার দাবি নিয়ে অসংখ্য সাহসী নাগরিক রাস্তায় নেমে পড়ে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়। বস্তুত ইউন যদি তার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে চাইতেন, তবে তার ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল; এই দিন শপথ পাঠ করে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাহলে হয়তো তার একনায়কতান্ত্রিক চক্রান্ত সফল হতো। এমনকি আমেরিকার হবু একনায়ক হয়তো তাকে অভিনন্দনও জানাতেন। ক্ষমতায় বহাল থাকার জন্য তাকে আর ব্যালট বাক্সের জটিলতায় যেতে হতো না।

এখন নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্ট ইউনের অনুশোচনা হচ্ছে। অভিশংসনের পাশাপাশি হয়তো আরও কঠোর শাস্তির শিকার হতে হবে তাকে। ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোকে এমন পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচার চর্চা করেছেন যেই সরকারপ্রধানরা, তাদের তালিকায় বলসোনারোর নাম রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃঢ় সমর্থনকারী এই নেতা এবং তার ডানপন্থি ৩৬ জন সঙ্গীর বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থানের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ২০২২-এর অক্টোবরের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। আর নভেম্বরেই তিনি ষড়যন্ত্র করেন অভ্যুত্থান ঘটানোর। এক পুলিশ প্রতিবেদনে জানানো হয়, বলসোনারো আর তার চরমপন্থি সঙ্গীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎখাত করার পরিকল্পনা করছিলেন।

ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালেক্সিস দে তকভিল জনগণকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলের ওপর আস্থা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিন্তু এরকম নেতাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ গণতন্ত্রের জন্য হানিকর বলে মন্তব্য করেছেন। ইউন, ট্রাম্প, বলসোনারো এবং নেতানিয়াহুর মতো চরমপন্থি নেতারা উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। বর্তমান যুগের রাজনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবিলায় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা নয়, সততার প্রয়োজন।

লেখক: আলজাজিরার কলামিস্ট। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা পৌঁছেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী

অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন দুই ট্রেনের হাজারো যাত্রী

আর্জেন্টিনা ভক্তদের জন্য সুখবর, মাঠে ফিরেছেন তারকা ফুটবলার

দুই হাতে বল নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ‘বাইক স্ট্যান্ট’, ভিডিও ভাইরাল

সব বলে দেওয়ার হুমকি দিলেন ঢাবি ভিসি

পাওনা ৭০০ টাকায় কাল হলো রিকশাচালকের

যুবদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ২ বন্ধু আটক

 অমর্ত্য সেনকে কি বাংলাদেশে বের করে দেবে ভারত?

রাজধানীতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ , যান চলাচল বন্ধ

ডিভোর্সের গুঞ্জন, মুম্বাই বিমানবন্দরে গোবিন্দ

১০

যমুনা ব্যাংকে চাকরি, আবেদন করুন আজই

১১

উপদেষ্টারা অসহায়, সবকিছু নির্ধারণ করে আমলারাই : ফখরুল

১২

ড. ইউনূসের কারণে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ : প্রেস সচিব

১৩

নির্বাচন নিয়ে অনৈতিক চাপ দিলে পদত্যাগ করব : সিইসি

১৪

যাতায়াত সুবিধাসহ আরএফএল গ্রুপে চাকরির সুযোগ

১৫

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ইরানের সেনাপ্রধানের হুংকার

১৬

বাজার স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে ইরানের অনুকরণে ব্যবস্থার ঘোষণা সিরিয়ার

১৭

সকালে সময় বাঁচাতে রোজ পাউরুটি খাচ্ছেন? চিকিৎসকদের স্পষ্ট সতর্কবার্তা

১৮

ঈদে মিলাদুন্নবী কবে, জানা যাবে সন্ধ্যায়

১৯

নির্বাচনের আগেই লুট হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার করা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

২০
X