বাঙালির শোকের মাস আগস্ট। জাতির পিতার হত্যার মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়েছিল জাতির পিতাকে সপরিবারে। মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য কাজটি করেছিল ষড়যন্ত্রকারী ও হত্যাকারীরা—আইন করে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিষিদ্ধ করে। সংবিধানে পর্যন্ত এই ইনডেমনিটি সংযোজন করা হয়েছিল। সেদিন মানবতার ধ্বজাধারী দেশ এই জঘন্য ইনডেমনিটি বাতিলের কথা বলেনি। খন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া, এরশাদ আর গণতান্ত্রিক শাসক খালেদা জিয়া পর্যন্ত বহাল রাখেন। চুপ থাকেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করে। নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে বিচার সম্পন্ন হয়। এরপর আপিল বিভাগে আবার বিপত্তি ঘটে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতাহারা হয়, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে। তারা আপিল বিভাগে বিচারক সংকট সৃষ্টি করে আপিল শুনানির পথ রুদ্ধ করে রাখে। বিএনপি-জামায়াতের আমলে আপিল শুনানি আর হয়নি। তারপর ওয়ান-ইলেভেন, নির্বাচন, আওয়ামী লীগের আবার ক্ষমতায় আসা—কত ঘটনা। শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার একটি দৃশ্যমান বিচার হয়েছে। নিম্ন ও মাঝারি পদের কিছু বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তার বিচার হয়েছে। কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে, কয়েকজন পলাতক। বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচার হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে অনেক কুশীলব ছিল। তাদের চিহ্নিত করার জন্য একটা কমিশন গঠনের দাবি ছিল। সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে এ দাবি উঠলে সরকার বিশেষ করে আইন মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই বলে আসছে, কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো টানা তিন দফায় ক্ষমতায় থেকে গত ১৫ বছরেও এই কমিশন আলোর মুখ দেখেনি। কমিশন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। আদৌ এই কমিশন হবে কি না, সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা কেউ কিছু বলতে পারছেন না। প্রতিবছর আগস্ট মাস এলেই প্রসঙ্গটি আবার সামনে আসে। মিডিয়ার লোকজন আলোচনায় নিয়ে আসেন। যথারীতি বলা হয়, হ্যাঁ, হ্যাঁ কমিশন হচ্ছে। হয়ে যাবে শিগগির... তারপর মাস যায় বছর যায় কমিশন আর হয় না। এবারও হয়তো তাই বলবেন। অথচ এই কমিশন গঠন করে, অনুসন্ধান করে জাতির পিতাকে হত্যার নেপথ্যে কারা কলকাঠি নেড়েছিল, কারা ষড়যন্ত্র করেছিল—এটা বের করা জরুরি ছিল। জাতির সামনে এদের চিহ্নিত করা দরকার ছিল। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে কিছু নিম্নপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা জড়িত ছিল। তাদের বিচার হয়েছে; কিন্তু এটাই শেষ নয়। নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীরাই আসল। যারা উসকে দিয়েছিল, যারা নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল—এদের চিহ্নিত করে দেশবাসীকে না জানালে সত্য চাপা পড়ে থাকবে। খণ্ডিত বিচার নিয়ে বসে থাকতে হবে। এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগ কেন জাতির পিতা হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করতে পারল না, কমিশন গঠন করে বের করতে পারল না, তা রহস্যজনক। এটা দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নৈতিক ব্যর্থতা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র এক মাস ১০ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এই বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক। পরে মোশতাককে হটিয়ে ক্ষমতার দখল নেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চম সংশোধনী) করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সাংবিধানিক বৈধতা দেন। কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার রুদ্ধ করে সংবিধান সংশোধন করে তা অন্তর্ভুক্ত করার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়, বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যা মামলার বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। বিচারিক আদালতে এই মামলার বিচার প্রচলিত আইনে সম্পন্ন হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারে সরাসরি জড়িত কিছু সেনাসদস্যের ফাঁসির রায় হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীরা আড়ালেই থেকে যায়। এই ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে না পারলে বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ বিচার সম্পন্ন হবে না বলে মনে করে সচেতন মহল। এদের চিহ্নিত করার জন্যই দরকার কমিশন গঠন করা। এটা গঠন করতে যত বিলম্ব হবে জাতির কাছে দায়ভারও তত বাড়বে। তবে সরকার বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে না পারলেও ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটন থেমে থাকবে না। সত্য প্রকাশ হবেই।
লেখক : সাংবাদিক
তথ্যসূত্র : বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যা মামলার রায়, বিবিসিসহ বিভিন্ন মাধ্যম
মন্তব্য করুন