এম এম আকাশ
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৫ এএম
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দারিদ্র্যের কশাঘাতে বাংলাদেশ

দারিদ্র্যের কশাঘাতে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণ বর্তমান খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির কারণে বাধ্য হয়ে শুধু খাদ্য গ্রহণই কমাননি, খাদ্যের মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি প্রোটিনের মাত্রা কমিয়ে শুধু ভাত বা আটা জাতীয় শর্করা দিয়ে পেট ভরাতে বাধ্য হচ্ছেন। সবচেয়ে দরিদ্ররা হয়তো পেট ভরে ভাতটুকু খেতে পারছেন না।

সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে শিল্প শ্রমিকদের জীবনযাত্রার অবস্থা, মূল্যস্ফীতি ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে একটি আলোচনা সভায় এই বাস্তবতা উঠে এসেছে। এই সেমিনারে বক্তা ছিলেন বিআইডিএসের বর্তমান ডিজি ড. বিনায়ক সেন। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মইনুল হোসেন।

সেখানে বিআইডিএসের ২০২৩-২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত ৬৪ জেলার ৬৪টি গ্রামের ৩ হাজার ৮৮৭ পরিবারের ওপর পরিচালিত একটি জরিপলব্ধ তথ্যাবলি তুলে ধরা হয়। এসব তথ্য উপরোক্ত বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ দেখিয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্রের বদৌলতে এটাও আমরা জেনেছি যে, বর্তমানে প্রায় ২ কোটি লোক বাংলাদেশে রয়েছে, যারা দুদিন কাজ বা আয় করতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে বাধ্য হবেন। এমনিতেই আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকের সংখ্যা করোনাকালে বেড়ে হয়েছিল ৪০ শতাংশ। পরে বিগত সরকার দাবি করেছিল যে, এটা করোনার পর কমে ১৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধির কারণে শহরের শ্রমিক ও গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষদের নির্ধারিত বা উপার্জিত প্রকৃত আয় কমে গেছে। যে টাকা তারা হাতে পান, তাতে ছেলেমেয়ে নিয়ে পেট ভরে খাওয়াই কঠিন হয়ে গেছে।

বিশেষ করে শহরের শ্রমিকদের জন্য গৃহের খরচ, যাতায়াতের খরচ, জ্বালানি খরচ ইত্যাদি এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এসবের পর হাতে যা যৎসামান্য থাকে, তা দিয়ে তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় ৩ হাজার ক্যালরির সমান পুষ্টিকর খাদ্য সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না।

যদি আমরা নতুনভাবে দরিদ্র হয়েছেন—এরকম ২ কোটি লোককে হিসাবে ধরি, তাহলে আমাদের জাতীয় দারিদ্র্য হার ফের ৪০ শতাংশে পৌঁছে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। নীতিনির্ধারকদের এটা নিয়ে মোটেও মাথাব্যথা নেই বলে জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে।

বিআইডিএসের জরিপ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের চেয়ে ২০২৩ সালের একই সময় মোট ১১ ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও সরকারি হিসাবে এখনো গড় মূল্যস্ফীতির হার ১০-১২ শতাংশ দাবি করা হয়।

সম্প্রতি মূল্যস্ফীতিকে প্রধান উপদেষ্টা এক নম্বর সমস্যা বলার পরও আমদানি ঘাটতি, চাঁদাবাজি, মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের দাপট এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে বর্তমান সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অপারগ হয়েছেন।

বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে অন্যকে দায়িত্ব দিয়ে এরই মধ্যে বিদায় নিয়েছেন। আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী আসল জায়গায় হাত না দিয়ে বর্তমান সরকার সুদের হার বাড়িয়ে, চাহিদা ও ঋণ সংকুচিত করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। কিন্তু উন্নত দেশের জন্য এটা অধিক কার্যকরী হলেও এ দেশে তা হচ্ছে না। যেহেতু এ দেশে এখনো মন্দা চলছে, যদি চাহিদাও ঋণ নিয়ন্ত্রিত হয়ে কমে আসে, তাহলে মন্দা আরও গভীর হবে।

ব্যাংক যদি উৎপাদনশীল খাতগুলোতে যথাযথ মাত্রায় চলতি মূলধন সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও সরবরাহ ব্যাহত হবে। তাতে দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশে একই সঙ্গে মন্দা বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে। এই জটিল পরিস্থিতিকে অর্থনীতিবিদরা নাম দিয়েছেন মন্দাস্ফীতি। ইংরেজিতে বলে stagflation. মন্দাস্ফীতি কমাতে হলে একই সঙ্গে সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে, সরবরাহ খরচ কমাতে হবে, অপচয় ও লুণ্ঠন কমিয়ে সাপ্লাই চ্যানেলকে প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে।

ভোক্তা ও উৎপাদকদের মধ্যে সরাসরি সম্পর্কের নতুন সমবায় কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান নীতিনির্ধারকদের দর্শনগত সংকীর্ণতা ও পাশ্চাত্য নির্ভরতার দরুন তারা এসব বিকল্প নীতিমালার প্রতি মনোযোগ দিতে পারছেন না। তারা এই পথে এগোতে রাজিও নন। মুক্তবাজার পথকেই তারা আদর্শ পথ হিসেবে বিবেচনা করেন অথবা বড়জোর ড. ইউনূসের তথাকথিত ‘মানব দরদি পুঁজিপতি’ বা ‘সোশ্যাল এন্টারপ্রেনার’দের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তারা। কিন্তু শ্রেণি চরিত্রের কারণে সেখানে কোনো সাড়া মিলছে না। উপরন্তু উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত লুটপাটের বোঝা আরও জটিল হচ্ছে। যেহেতু তাদের কাছ থেকে বাস্তবে কোনো টাকা উদ্ধার করা যায়নি, বরং তারা সব দ্রুত পাততাড়ি গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। সেজন্য তাদের প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো এখন রীতিমতো বন্ধ হয়ে দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছে। গত্যন্তর না দেখে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটছেন এবং ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে অর্থনীতিতে তা ইনজেক্ট করেছেন। কিন্তু এই টাকার বৃহত্তর অংশটি সেখানে না দিয়ে উৎপাদনশীল খাতে দিলে হয়তো আরও ভালো ফল পাওয়া যেত। বৃহৎ ব্যক্তি খাতকে টাকা ছাপিয়ে বা জনগণের করের অর্থ থেকে অর্থ নিয়ে বেল-আউট করার এই কৌশল হচ্ছে আমেরিকান কৌশল, যেটা ২০০৮-এর পুঁজিবাদী বিশ্বের আর্থিক সংকটের সময় নেওয়া হয়েছিল। এখন এটা আমাদের দেশেও আবার ফিরে আসতে যাচ্ছে।

ক্রম অবনতিশীল শহুরে দারিদ্র্য ও করণীয়:

বিআইডিএসের মতে, উৎপাদন খাতে নিয়োজিত একজন শ্রমিকের চার সদস্যের পরিবারের জন্য বেঁচে থাকার ন্যূনতম মাসিক ব্যয় হচ্ছে ২২ হাজার ৯৭৯ টাকা।

গবেষক আরও বলছেন, কম খেয়ে, বেশি কাজ করে শ্রমিকরা এ পরিমাণ টাকা আয়ের জন্য চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে উৎপাদন খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রায় এক পঞ্চমাংশ (২০ শতাংশ) এ পরিমাণ আয় করতে সক্ষম নন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন ছাঁটাইকৃত শ্রমিকরা। তারা বাধ্য হয়ে অটো বা রিকশা ভ্যান, ফেরিওয়ালা, কুলিগিরি, নির্মাণকাজ অথবা গ্রামে ফিরে কৃষি ইত্যাদির মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক হিসেবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। তাদের সংখ্যাই বর্তমানে প্রধান। সমগ্র শ্রমিক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ। তাদের আয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব কম। সর্বনিম্ন দৈনিক ১০০ টাকা। সর্বোচ্চ দৈনিক ৫০০ টাকা।

এদিকে হাইকোর্টের এক রায়ে এ অটোরিকশা শ্রমিকদের ওপর হঠাৎ করে বিকল্প ব্যবস্থা না করেই বেকারত্বের খড়্গ চাপিয়ে দেওয়া হয়। তবে বামপন্থিদের নেতৃত্বে বিপুল আন্দোলন হওয়ায় সেই রায় আবার প্রত্যাহার হয়েছে। যদিও ২৫ ডিসেম্বর জানা যাবে চূড়ান্ত রায় ও সরকারের নীতিনির্ধারক এ ক্ষেত্রে কী করবেন। সেটি নিয়ে বর্তমানে ৬০ লাখ অটোরিকশাচালকের আড়াই কোটি শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে এবার সম্ভবত বিনাযুদ্ধে পশ্চাদপসারণ করবেন না।

উন্নত পুঁজিবাদী দেশে এমনকি প্রাচীন দাস ও সামন্ত সমাজেও সর্বহারা প্রলেতারিয়েত বা দাস অথবা ভূমিদাসের শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের জন্য যতটুকু দেওয়া দরকার, ততটুকু সভ্য বুর্জোয়া, প্রাচীন দাসমালিক এবং অভিজাত ভূস্বামীরা দিতে কার্পণ্য করতেন না। কারণ শ্রমশক্তির উৎস এই মানুষগুলোই হচ্ছে তাদের জন্য স্বর্ণডিম্ব প্রসবিনী হংসের মতো। একে বাঁচিয়ে না রাখলে এবং কাজে না লাগালে তারা তাদের মুনাফা, সুদ ইত্যাদি উদ্ধৃত্ত আয় ও বিলাসব্যাসন অব্যাহত রাখতে পারবেন না। কিন্তু অনুন্নত দেশের পরনির্ভর লোভী-লুটেরা বুর্জোয়া হাঁসটিকে মেরে একসঙ্গে সব ডিম আত্মসাৎ করতে চান। সেজন্য এখানে শ্রমজীবীরা (আনুষ্ঠানিক খাতের বা অনানুষ্ঠানিক খাতের) এক বিশেষ ধরনের নির্মম শোষণের শিকার হচ্ছেন। তারা তাদের ন্যূনতম দারিদ্র্য আয়টুকুও অব্যাহত রাখতে পারেন না। চাকরিরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাদের তাই এখন ‘প্রলেতারিয়েত’ না বলে এমনকি উন্নত দেশেও নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রিকারিয়েত’ (Precariat). এখন অনেক শিক্ষিত নিম্নবিত্ত এসে সেখানে যোগ দিচ্ছেন। তাদের নতুন বাংলা নাম হচ্ছে ‘নিরাপত্তাহীন সর্বহারা’ বা ‘অনিশ্চিত ভাসমান শ্রমজীবী’। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাতের এ ধরনের শ্রমজীবী তথা বাংলাদেশের উৎপাদনশীল আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক সর্বহারা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ‘নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত শ্রমজীবীর’ মিলিত বাহিনীটি বর্তমানে সমগ্র সমাজে প্রায় অতি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শতাংশে পরিণত হয়েছে। একার্থে এরা কেউই কোনো না কোনোভাবে দারিদ্র্য হুমকি থেকে মুক্ত নয়।

যদি আমরা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন ও চাকরির নিরাপত্তাকে স্থায়ী ও একত্রিত করে দারিদ্র্য বিমোচনকে ৭২-এর সংবিধানের আলোকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করি, তাহলে প্রায় ৬০-৭০ ভাগই কমবেশি দরিদ্র বা নাজুক অবস্থার সম্মুখীন। সময় এসেছে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদেরও মিলেমিশে এ অসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অগ্রবাহিনী হিসেবে রুখে দাঁড়ানোর।

লেখক: অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্বর্ণ কিনবেন? জেনে নিন আজকের বাজারদর

সাতসকালে অস্ট্রেলিয়ায় বিমান বিধ্বস্ত

ভলিবল কোচের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ, কলেজছাত্রীর মৃত্যু

চশমা পরে লালগালিচায় বিড়ালের ‘ক্যাটওয়াক’

যেভাবে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে জয়সূচক গোলের দেখা পেল আর্জেন্টিনা

আবাসন সুবিধাসহ নিয়োগ দিচ্ছে আরএফএল গ্রুপ

১১ অক্টোবর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

চীনা পণ্যে বাড়তি ১০০ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা ট্রাম্পের

ঢাকায় কখন হতে পারে বৃষ্টি, জানাল আবহাওয়া অফিস

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নতুন কর্মসূচি আজ

১০

ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে মেসিবিহীন আর্জেন্টিনার জয়

১১

গাজা শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে মিশরে যাচ্ছেন ট্রাম্প

১২

নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও লেকর্নুকে নিয়োগ দিলেন মাখোঁ

১৩

চীন বিশ্বকে জিম্মি করে রেখেছে : ট্রাম্প

১৪

বাংলাদেশের ম্যাচসহ টিভিতে আজকের যত খেলা

১৫

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

১৬

যুক্তরাজ্যে তিন মাসে ২২টি মসজিদে হামলা, কারণ কী?

১৭

দেশে ফিরে যা বললেন শহিদুল আলম

১৮

শনিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৯

১১ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

২০
X