বিগত বছরগুলোয় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো চালু হলেও নতুন শিল্প খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকটসহ নানা কারণে পুরোনো কারখানা যে হারে বন্ধ হয়েছে, এর বিপরীতে নতুন শিল্পকারখানা চালু হয়নি। করোনা মহামারির কারণে দুই বছরের মতো অনেক কারখানা বন্ধ ছিল এবং অনেকে আবার স্বল্প সক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে শিল্প সম্প্রসারণ আরও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। এতে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছেন না দেশীয় বিনিয়োগকারীরা। বরং অনেকেই দেশের অর্থ বৈধ ও অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করে অন্য দেশে বিনিয়োগ করেছে। সাম্প্রতিক অনিশ্চয়তায় আশা পাচ্ছেন না বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও। এতে শিল্প খাতে কাঙ্ক্ষিত সম্প্রসারণ হচ্ছে না। ফলে প্রবৃদ্ধিও আশানুরূপভাবে হচ্ছে না। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকা অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো দিক নয়। কেননা কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ জিডিপিতে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে আসার চিত্র বিবিএস থেকে সহজেই পাওয়া যায়। বিবিএসের তথ্যানুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। পরের বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিল্পের প্রবৃদ্ধি গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে আসে। সে বছর প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন। এতে সারা দেশে শতাধিক কারখানায় হামলা হয়েছে। দুই শতাধিক কারখানা তখন বন্ধ রাখতে হয়েছে। শ্রমিক নেতাদের ভাষ্যমতে, এতে সবমিলিয়ে শিল্প খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে। শিল্পে কাঁচামাল সরবরাহে সংকটের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ, পতিত স্বৈরাচার সরকারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। কমেছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিনিয়োগ এসেছে ১৪৭ কোটি ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৬১ কোটি ডলার। বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। ফলে বেকারত্ব বাড়তে থাকে। দেশে বর্তমানে বেকার ২৬ লাখ ৬০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালের শুরুতে দেশে বেকার মানুষ কম থাকলেও বছর শেষে ধারাবাহিকভাবে এ সংখ্যা বেড়েছে। মূলত জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রভাবে বছরের শেষ সময়ে বেড়েছে বেকার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটেছে, যার ফলে দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে এই কৃষি খাত ও কৃষক সমাজ। এখন এই কৃষক প্রজন্মই শিল্পকারখানায় কাজ করে বাংলাদেশকে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশক ধরে বেসরকারি খাতের শিল্প ৩ হাজার থেকে বেড়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু কারখানার সংখ্যা বাড়লেও শিল্পকারখানায় তেমন গুণগত উন্নয়ন হয়নি। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির অনেক সম্ভাবনা থাকলেও অতীতের সরকারগুলো দেশের শিল্প বিকাশে নানা পদক্ষেপ নিলেও সেগুলো বাস্তবায়নে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নানা অনিয়মের কারণে যতটুকু উন্নতি হওয়ার কথা, তা না হয়ে বরং আনুপাতিকভাবে উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানার সংখ্যা বাড়ার পরিবর্তে কমেছে। সম্প্রতি সরকার শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে, তাতে শিল্প খাত কঠিন সময়ে পড়তে পারে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অর্থনীতির প্রতিটি খাতকেই প্রভাবিত করবে। আমাদের উৎপাদন খরচ, পরিচালন খরচ বিবেচনা করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। গ্যাস উত্তোলনের জন্য যে ধরনের বিনিয়োগ দরকার ছিল, যে ধরনের এক্সপ্লোরেশন দরকার ছিল—সেগুলোর উদ্যোগ ইতোপূর্বে নেওয়া হয়নি। এর ফলে সব জায়গায়ই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
মূল্যবৃদ্ধির পরও ব্যবসায়ীরা গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছেন না। সরবরাহে নতুন সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না, যাদের সংযোগ আছে তারাও পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে শিল্পকারখানা ও এর উৎপাদনে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিতে পারে। এর থেকে উত্তরণের জন্য মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। এতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অপচয় রোধ করতে হবে। অর্থনৈতিক স্থবিরতাকে দূর করতে হবে। শিল্পবিকাশ, শিল্প খাতের উন্নয়নে আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, রয়েছে কাঁচামালও। দেশে বন্ধ কারখানাগুলো চালু করতে হবে। বন্ধ জুট মিল, চিনিকলসহ যেসব কারখানা চালু করার সুযোগ রয়েছে, তা অনতিবিলম্বে চালু করা উচিত। প্রয়োজনে বিদেশি বিনিয়োগ এনে, জরুরি মেশিনারি আমদানি করে উৎপাদন চালু করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা দেশ-বিদেশে যেভাবে রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ সব শিল্পে গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের অনেক দক্ষ শ্রমিকও রয়েছে, রয়েছে অনেক অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান। প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও গাইডের অভাবে মেধাবীরা বিদেশে গিয়ে অন্য দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। আমাদের রয়েছে অনেক সৎ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবসায়ী। তাদেরসহ সবাইকে ব্যবসা করার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। শিল্প উদ্যোক্তাদের শিল্প স্থাপনের পথ সহজ করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার