কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর ‘উইমেন অব আলজিয়ার্স’ বিশ্বের সবচেয়ে দামি শিল্পকর্ম হিসেবে পরিচিত। নিলামে যেটি বিক্রি হয়েছে ১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশি টাকার হিসাবে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা। অতিমূল্যবান এ শিল্পকর্মের উপজীব্য হচ্ছে নগ্ন রমণী। নগ্নতা সবসময়ই অমূল্য! তবে তা দামি নাকি অশ্লীল, তা নির্ভর করে প্রকাশ করার দক্ষতার ওপর। শুধু নগ্নতা নয়, ছাগলও যে কত অসাধারণ, তাও ফুটে উঠেছে পিকাসোর তুলিতে। পিকাসোর তুলিতে ছাগলের ছবি অনবদ্য এক দ্যোতনা দেয়। যারা দেখেছেন, অনেকেই ছাগলের ভক্ত হয়ে গেছেন। অবশ্য তারা নিজেদের অসাধারণ এই প্রাণীটির মতো ভাবেন কি না, সে বিষয়টি জানা নেই। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ।
এদিকে পিকাসোর ছবি নিয়ে আমরা যত ভাবি, স্বদেশি শিল্পীদের ছবি নিয়ে হয়তো ততটা ভাবি না। অথচ আমাদের দেশের শিল্পীদের অনেক ছবি কালের সীমা অতিক্রম করে চিরকালীন হয়ে আছে। জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্মের মধ্যে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা বিশেষ খ্যাত। এ ছাড়া রয়েছে ১৯৫৭-এর নৌকা, ১৯৫৯-এর সংগ্রাম, ১৯৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। শুধু শিল্পীর তুলির আঁচড় নয়, ক্যামেরার অনেক ছবিও শৈল্পিক হয়ে ধরা দেয়। আবার কখনো ছবি ওলটপালট করে দিতে পারে। সাধারণত ছবি সত্যকে অগ্রগামী করে। আবার কখনো ছবির নেপথ্যে কদর্য উদ্দেশ্য থাকে, যা পিছিয়ে দেয়। এর উদাহরণ বিশ্ব এবং বাংলাদেশে অসংখ্য রয়েছে। অনেক ছবিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা রয়েছে। এর পাশাপাশি নেপথ্যে কদর্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছবিও কিন্তু কম নয়। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে বাসন্তীর জাল পরা ছবি, ভুখা মিছিল নিয়ে আসা মওলানা ভাসানীকে খাওয়ানো, এক বিডি মেম্বারকে গরু তাড়া করা, বুকে-পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ নূর হোসেনের ছবি এবং অতিসম্প্রতি গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে সকালে রাস্তায় ফেলে পর্যাপ্ত ‘বাটাম’ দেওয়ার পর দুপুরে এলাহি আয়োজনে পুলিশি ভোজ। এ ধারার ছবিগুলোর মধ্যে আবার অধিকতর প্রধান হচ্ছে বাসন্তীর জাল পরা ছবি এবং মওলানা ভাসানী ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে খাওয়ানো। বাসন্তীকেন্দ্রিক ছবির পেছনে ছিল সুগভীর ষড়যন্ত্র। আর ভাসানী ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে নিয়ে করা হয়েছে খুচরা চালাকি। সেকালে এ অপকর্ম করেছেন রাজনীতিক এবং একালে করেছে পুলিশ। বলে রাখা ভালো, সেকাল-একালের ক্ষমতা কেন্দ্রেও অনেক ফারাক।
আলোচিত ছবি প্রসঙ্গে একটু পেছনে ফেরা যাক। কথায় আছে—ছবি কথা বলে। ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত বাংলাদেশে বন্যা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। অনেকেরই বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য ৭৫-এর থিঙ্কট্যাঙ্কের নানামুখী কারসাজিতে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং এর ভয়াবহতা চরমে পৌঁছেছিল। এই দুর্ভিক্ষ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল বঙ্গবন্ধু সরকার। অন্যদিকে চলছিল একে পুঁজি করে মরণকামড় দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার খেলা। তখন স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্র মরিয়া হয়ে খেলছিল। এ ষড়যন্ত্রে অনেকের সঙ্গে শামিল ছিল ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মালিকানাধীন পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক। মনে রাখা প্রয়োজন, সেদিনের সঙ্গে আজকের ম্রিয়মাণ ইত্তেফাককে মেলানো যাবে না। তখন ইত্তেফাক ছিল হাইয়েস্ট সার্কুলেশনের পত্রিকা এবং দেশবাসীর বিশ্বাসের কেন্দ্র। এই ইত্তেফাক দুর্ভিক্ষের সন্ধানে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিল রিপোর্টার শফিকুল কবির এবং ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদকে। তাদের পাঠানো হলো রংপুর ও কুড়িগ্রামে। পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে হতদরিদ্র পরিবারের অনাহারী মেয়ে বাসন্তীর কাছে নিয়ে গেল বিশেষ এক গাইড। তাকে নগদ ৫০ টাকা দিয়ে একটি ফটোসেশন করার জন্য রাজি করানো হয়। বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, সেই সময়ের ৫০ টাকা কিন্তু আজকের ৫ হাজারের চেয়েও বেশি। আর দুর্ভিক্ষ চলাকালে অনাহারী অসহায় মানুষের কাছে সেই সময় ৫০ টাকার মূল্য নিশ্চয়ই পরিমাপের ঊর্ধ্বে। ফলে চকচকে ৫০ টাকার নোট পেয়ে বাসন্তী রাজি হয়ে গেল ফটোসেশনে। স্থানীয় গাইডে দূতিয়ালিতে গায়ে ছেঁড়া জাল জড়ানো বাসন্তী। তার পাশে ছিন্ন বসনা আর এক নারী। আফতাব আহমেদের ক্যামেরায় পূর্বপরিকল্পিত সাজানো ছবি ধারণ করা হলো। মিশন শেষ করে ঢাকায় ফিরলেন ইত্তেফাকের রিপোর্টার শফিকুল কবির এবং ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদ। সাজানো সেই ছবিগুলোর একটি ছাপা হয়েছিল ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় লিড হিসেবে। এই ছবিটি মুজিব সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এর সঙ্গে আরও অনেক ঘটনার ওপর ভর করে এলো ১৯৭৫ সালের ভয়াল ১৫ আগস্ট। বহু বছর পর অনেক সত্য উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি জানা গেল, বাসন্তীর ছবিটি ছিল সাজানো, টাকার বিনিময়ে ফটোসেশন। উল্লেখ্য, কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর আঁকা বিশ্বের সবচেয়ে দামি শিল্পকর্ম হিসেবে পরিচিত ‘উইমেন অব আলজিয়ার্স’-এর মডেল ছিলেন। তিনিও টাকার বিনিময়ে পিকাসোর মডেল হয়েছেন। বাসন্তীও টাকার বিনিময়ে জাল পরে মডেল হয়েছেন প্রায় নগ্ন অবস্থায়। এদিক থেকে দুজনই আলোচিত মডেল; কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে একজন শিল্পের জন্য, অন্যজন ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার। কোনো সন্দেহ নেই, ’৭৫-এর থিঙ্কট্যাঙ্কের নানামুখী ষড়যন্ত্রের বিপরীতে ক্ষমতাসীন লোকজন ছিল খুবই মাজুর দশায়। এদের অনেকের বুদ্ধি-বিবেচনাও ছিল শিশুপ্রবণতার কাছাকাছি। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে, ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় ভুখা মিছিল নিয়ে আসা মওলানা ভাসানীকে আপ্যায়িত করে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করা। এই কাণ্ড যারা করেছেন তারা সেই প্রবচন হয়তো বিবেচনায় নেননি, ‘ব্যাঙের মুতে বর্ষা হয় না।’ বাস্তবে হয়েছেও তাই। ভুখা মিছিল নিয়ে আসা মওলানা ভাসানীকে আপ্যায়ন করার ছবি প্রকাশ করে তেমন কোনো ফায়দা হয়নি। আরও একটি বিষয় আছে। তা হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ভাসানী কোন টিমের প্লেয়ার’ ছিলেন, তাও অনুধাবনে সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছিলেন তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় মওলানা ভাসানী কিন্তু তার সেই স্বভাবজাত আওয়াজ দেননি, ‘খামোশ...!!!’ বরং তিনি নিজেই খামোশ হয়ে গিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই কোনো মিশনের সদস্য ছিলেন। অথবা পরিস্থিতি মেনে নিয়েছেন। অথচ এই মাপের এক ব্যক্তিত্বকে আপ্যায়ন করে খুচরা চালাকি করা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। আবার একই ধরনের খুচরা চালাকি করা হয়েছে প্রায় অর্ধশত বছর পর গত ৩১ জুলাই। এটি করেছে পুলিশ। হাসিনা সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে রাজধানীর প্রবেশের প্রধান সড়কমুখে ওইদিন বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি ছিল। সেদিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এর সূচনা কোন পক্ষ করেছে তা বলা কঠিন। তবে ছবিতে দেখা গেছে, সমানতালে মারমুখী আচরণ করেছে বিএনপি ও পুলিশ। এর মধ্যে সকালে প্রধান ছবি হিসেবে ধরা দেয় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মাথায় পুলিশের লাঠির আঘাত, এরপর তাকে রাস্তায় ফেলে কোমর থেকে নিচের দিকে বেদম লাঠিপেটার দৃশ্য। রাজনীতির মাঠে পুলিশের এই আচরণ মোটেই নতুন কিছু নয়। পরিস্থিতি সামলাতে পৃথিবীর সব দেশের পুলিশই এরকম আচরণই করে। এ হচ্ছে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা; কিন্তু ইতিহাসের এই ধারার সঙ্গে আমাদের পুলিশ অন্যরকম এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তা হচ্ছে, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে আপ্যায়ন করে সেই ছবি প্রকাশ করে দেওয়া। হয়তো ভাবা হয়েছিল, এই ছবিটিও বাসন্তীর সাজানো ছবির মতো আলোড়ন সৃষ্টি করবে। যাতে বেকায়দায় পড়বে সরকারবিরোধী পক্ষ; কিন্তু বাস্তবে তা মোটেই হয়নি। এমনকি এই ছবি ১৯৭৪ সালের ভাসানীকে আপ্যায়নের ছবির প্রতিক্রিয়ারও কাছে যেতে পারেনি; বরং হয়েছে বুমেরাং। যে কেউ বোঝেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মাথা ফাটিয়ে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক প্রহার করার পর ডিবি পুলিশের অফিসে নিয়ে যাওয়া মানে তাকে গ্রেপ্তার করার আলামত। এ অবস্থায় দুপুর হলে নিশ্চয়ই তাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পুলিশের, যা শুধু নেতা নয়, ছিঁচকে আসামিকেও খাওয়ানোর দায়িত্ব পুলিশের। অবশ্য সাধারণ আসামিদের বেলায় পুলিশ এটি করে না। বরং বাইরে থেকে স্বজনদের আনা খাবার হাজতখানায় পৌঁছানোর জন্য পুলিশকে টাকা দিতে হয়। এটি গোপনীয় কোনো বিষয় নয়। প্রচলিত এই ধারা হেভিওয়েট কোনো আসামির বেলায় চলে না। খুবই বোধগম্য বিষয়, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গেও এমনটা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো কারণ নেই; কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় হয়ে আছে, সেই ছবি প্রকাশ করা, যা থেকে আসলে সরকার বা পুলিশের কোনো অর্জন হয়নি, যা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এটি সবাই বোঝেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন আর দড়িকে সাপ হিসেবে দেখানো সম্ভব নয়। এই চেষ্টা করা এক ধরনের বালখিল্য আচরণ!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
মন্তব্য করুন