গানের কোনো সীমানা হয় না। থাকে না বা মানে না কোনো দেয়াল। ইংরেজি উর্দু-আরবি-হিন্দি এমন সব ভাষার গানকেই আপন করে নিই আমরা। ইদানীংকালে জামাল জামাল নামে যে গানটি বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদৃত, সে জামাল কুদু গানের মানেই বুঝি না! কিন্তু তাতে কি? তার সুর আর কণ্ঠমাধুর্য সব সীমানা দেয়াল ডিঙিয়ে হানা দিয়েছে বাঙালির আসরে। আর বাংলা গান যদি তেমন গান হয়, সে তো অনায়াসেই ঢুকে পড়বে অন্দরমহলে।
আমি তখন সিডনিতে বসবাস শুরু করেছি মাত্র। বাংলাদেশ থেকে কালেভদ্রে অতিথি আসতেন। বন্ধু বিরূপাক্ষ পাল এক তরুণীকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। তার কণ্ঠে আমি প্রথম এই গানটি শুনি। তাও কবিতা আকারে। কথা আর সুরের ধারায় ভেসে যাওয়া সে কবিতাই প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে চিনিয়েছিল। তারপর মুগ্ধতা। কিছুদিন পর বাংলাদেশের এক গায়ক মাহমুদজ্জামান বাবুর কণ্ঠে সে গান ধ্বনিত হতে শুরু করে। তৈরি হয় ধোঁয়াশা। টিভি স্ক্রলে বাবুর নাম দেখে অনেকেই ধন্দে পড়ে যান। কারণ তখনো প্রতুল ছিলেন অচেনা। কিন্তু সত্য তো আলোর মতো। সে যখন ছড়িয়ে পড়ে তার আলোয় মিথ্যা দূর হতে বাধ্য। বাংলাদেশের টিভিতে এসে এ গান বিষয়ে তার কথা জানিয়ে যান প্রতুল মুখোপাধ্যায়। বিনয়ী মানুষ বিনীতভাবেই নিজের সৃষ্টির কথা বলতেন তিনি।
গানটি এমন এক গান, যা শতবর্ষের আয়ু নিয়ে জন্মেছে। যেমন তার বাণী, তেমনি তার সুর। স্রষ্টার খালি গলায় এ গান শুনতে শুনতে বাঙালি চলে যায় স্মৃতি ও অতীতের গৌরব ভূমিতে। আমি বলব রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পর এমন গান খুব কম হয়েছে। এ গানের সঙ্গে জীবনানন্দের মিল অধিক। বলতে গেলে জীবনানন্দের পর এভাবে বাংলাকে আবিষ্কার করেননি কেউ।
‘বাংলা আমার তৃষ্ণার জল তৃপ্ত শেষ চুমুক
আমি একবার দেখি বারবার দেখি দেখি বাংলার মুখ।’
জীবনানন্দের বহুকাল পর কেউ এমন করে বাংলাকে দেখলেন। বেশি কিছু লাগে না। হওয়ার মতো একটি হলেই হয়। এক গানে বাঙালির হৃদয় মন জয় করেছেন তিনি। ভদ্রলোক দেখতে ক্ষীণকায় কিন্তু তার গানের জগৎ অসীম ভরাট। বাম আদর্শ বহু মানুষের সর্বনাশ করেছে। আমার মতে, তারও করেছে। বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না—এমন একটা অসামান্য পঙক্তিও এখন হৃদয়ে আঘাত করে না মানুষের। কিন্তু ওই যে বললাম, একটিই যথেষ্ট।
‘আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়
মেশে তের নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়..’
এমন গান শতবর্ষে তৈরি হয় না। হবেও না।
অবিভক্ত বাংলার বরিশালে ১৯৪২ সালে জন্ম প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের। বাবা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন শিক্ষক। মা বাণীদেবী গৃহিণী। স্কুলজীবন থেকেই গানের রাখালিয়া সুরের প্রতি টান ছিল। সেই টান থেকেই ১২ বছর বয়সে মঙ্গলচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’তে সুরারোপ। তারপর কালক্রমে ২০০টিরও বেশি গান রচনা করেছেন, গেয়েছেন, সুর দিয়েছেন। সবই বাংলায়। গণসংগীত নিয়ে থেকেছেন, কিন্তু কোনো বিশেষ ধরনে আবদ্ধ হয়ে থাকেননি। মাঝিমাল্লাদের থেকে যেমন ভাটিয়ালি শিখেছেন, তেমনই অনুপ্রেরণা নিয়েছেন বাংলা আধুনিক গান থেকেও। এমনকি জাপানি গান থেকেও শুষে নিয়েছেন গানের মূল্যবোধ।
সচরাচর কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন না প্রতুল মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সেতারের সুর পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন স্পষ্ট ভাষায় কথা বলাও। আক্ষরিক অর্থেই। গান শুনতে শুনতে একটি অনুষ্ঠানে এক অনুরাগী তাকে জানান, পঙক্তির শেষের দিকের শব্দগুলো ঠিকমতো শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর থেকে উচ্চারণ নিয়ে মারাত্মক সতর্ক থাকতেন। বিকৃত উচ্চারণ পছন্দ করতেন না। তার উচ্চারণের মতোই স্পষ্ট ছিল রাজনৈতিক বক্তব্যও। মানুষের মুক্তির গান বারবার উঠে এসেছে তার গলায়।
তার দুঃখ ছিল বাঙালি গান শোনে না। বিশেষ করে বাণীপ্রধান অসাধারণ গানের যুগ যেন শেষ। সত্যি তাই। এককালে হেমন্ত মান্না দে সলিল চৌধুরী কিংবা সুকান্ত মিলে যে গানের জগৎ, তা এখন উধাও। উধাও আমাদের দেশের গানের মর্মবাণী। তবু আমি বলব আমাদের বাংলাদেশে নাই নাই করেও দেশের গান টিকে আছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশের গানের উজ্জ্বলতা ছিল অসাধারণ। সে যাত্রায় সে স্রোতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। হয়তো এজন্য দায়ী সময়; হয়তো অন্য কিছু। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রজন্মের বড় হওয়ার সময়কালও একটা ব্যাপার। এখনকার প্রজন্মের ভাবনা মন-আবেগ আমাদের মতো নয়। হবেও না। তবু আমাদের যে শাশ্বত ভালোবাসা আর সাম্যের আগ্রহ, সেটা মুছে যায়নি।
যায়নি বলেই প্রতুল মুখোপাধ্যায় ছিলেন। অধ্যাপনা থেকে অবসরকাল চেষ্টা করেছেন ভাষার প্রতি তার আজন্মলালিত ভালোবাসা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার। শেষ বয়স পর্যন্ত দৃপ্ত গলায় গেয়েছেন বাংলা গান, বাংলার গান। বাংলা যে তার ‘দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর ধনুক’। একটা দৃশ্যকল্প ভাবুন। কোনো যন্ত্র নাই, যন্ত্রের আধিক্য নাই, অনেক বয়সী একজন মানুষ গাইছেন দেশের গান। গাইছেন সাম্য ও স্বপ্নের গান। খালি গলায় এ গানে তিনি মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন জনারণ্যে। আজ এমন ভাবাও দুঃস্বপ্নের মতো।
কবি মঙ্গলচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতা দিয়ে শুরু। নিজেও গান লিখতেন। অথচ প্রথাগত কোনো সংগীতশিক্ষা তিনি নেননি। নিজের হৃদয় আর আবেগেই গান বাঁধতে শিখে গিয়েছিলেন। সে গান যদি তৈরি না হতো আমরা পেতাম না এমন কালজয়ী শিল্পী। পেতাম না আমাদের মাটির কাছাকাছি এমন কোনো গায়ক। নিজে লিখে নিজের সুরে নিজের বয়সী কণ্ঠে এমন ভুবনমাতানো বাঙালি বিরল।
অনেকে মনে করেন, তার গানের কথা ছিল ভারী। কথার কারণে গানের সুরময়তা অনেক সময় হোঁচট খেয়েছে। হতে পারে। এমন কথার গান ভারী মনে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সুরসাধনা আর গানের বৈরী সময়ে বড় অপ্রতুল এমন একজন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। তার বয়স হয়েছিল। ছিলেন অসুস্থ। তারপরও এ চলে যাওয়া সুরের আকাশে মেঘের দাপটে ঝড়ে যাওয়া কোনো তারকা পতনের মতো।
বাংলার মেঠোপথ ধরে চলে যাওয়া আমাদের প্রতুল মুখোপাধ্যায় তারার দেশে ভালো থাকুন এ প্রার্থনা।
লেখক: সিডনিপ্রবাসী ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক