ড. সিনেম চেঙ্গিস
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এশিয়াকেন্দ্রিক তুরস্কের নতুন পরিকল্পনা কী

এশিয়াকেন্দ্রিক তুরস্কের নতুন পরিকল্পনা কী

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রস্তুত হচ্ছে তুরস্ক। পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনার যে উদ্যোগ তুরস্কের সরকার সম্প্রতি গ্রহণ করেছে, তারই দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখা যাচ্ছে তাদের এশিয়াকেন্দ্রিক নতুন কর্মসূচি। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান সফর করেন। রাষ্ট্রীয় সফর হিসেবে তার এই ভ্রমণের তাৎপর্য বহুমাত্রিক এবং এর ফল সুদূরপ্রসারী বলে মতপ্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০১৯ সালে তুরস্ক ‘এশিয়া এনিউ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি। প্রথমত, এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে তুরস্কের শক্তিশালী নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত, এশিয়ার বাজারে তুরস্কের ব্যবসার দ্বার উন্মোচন করে এ অঞ্চলে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে জোগান নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। ২০২৪-২৬ সালের মধ্যে এ কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে তুর্কি সরকারের। আসিয়ান, ব্রিকস, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এবং ডি৮-এর (আটটি উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা) মতো প্রভাবশালী সংগঠনের সদস্য হওয়ায় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বর্তমানে তুরস্কের এ কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এশিয়া সফরে এরদোয়ানের প্রথম গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। ২০১৯ সালের পর এই দেশে আর ভ্রমণ করেননি তিনি। তুর্কি সরকারের ভাষ্যমতে, মালয়েশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সুসংহত করার বহুমুখী ফায়দা রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে তুরস্ক আসিয়ানের সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণ করে আসছে। মালয়েশিয়া ২০২৫ সালে এ সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে। বর্তমানে তুরস্ক সংগঠনটির আংশিক সংলাপ সহযোগী হিসেবে রয়েছে। দেশটির লক্ষ্য পূর্ণাঙ্গ সংলাপ সহযোগীর মর্যাদা অর্জন করা। আসিয়ানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে মালয়েশিয়ার সমর্থন—এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৯৭ সালে ইস্তাম্বুলে ডি৮ জোটটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তুরস্কের পাশাপাশি মালয়েশিয়াও এ জোটের সদস্য। এ ছাড়া অন্যান্য সদস্যের মধ্যে রয়েছে ইরান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মিশর ও নাইজেরিয়া। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার একটি সক্রিয় সদস্য হওয়ায় মালয়েশিয়া তুরস্কের সঙ্গে মিলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মালয়েশিয়া সফরের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার পুনর্গঠন। মালয়েশিয়া এ বিষয়ে একটি তহবিল গঠনে সহায়তার অঙ্গীকার করেছে। একই সঙ্গে গাজা ও ফিলিস্তিন পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কমিটির সহসভাপতি পদের দায়িত্বও গ্রহণ করেছে মালয়েশিয়া। বৈঠক চলাকালে এরদোয়ান জোর দিয়ে বলেন যে, গাজার পাশাপাশি অন্যান্য বৈশ্বিক মানবিক সংকট মোকাবিলায় ওআইসি এবং ডি৮-এর মতো জোটগুলোর ভূমিকা অপরিহার্য। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়াই আসিয়ানের প্রথম সদস্য রাষ্ট্র যে ২০১৪ সালে তুরস্কের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে।

নিরাপত্তার স্বার্থে তুরস্কের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক লক্ষণীয়। মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করার প্রক্রিয়ায় তুরস্ককে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তুরস্কের সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদির প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে তারা। তুর্কি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এসটিএমের সঙ্গে ২০২৪ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে মালয়েশিয়া। এ চুক্তির আওতায় তিনটি করভেট যুদ্ধজাহাজ কিনে নেয় মালয়েশিয়ার সরকার। এ ছাড়া এরদোয়ানের সফরকালে স্বাক্ষরিত হয় ১১টি চুক্তি, যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার স্পষ্ট নজির।

মালয়েশিয়া সফরের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দ্বিতীয় গন্তব্য ছিল ইন্দোনেশিয়া। এ সফর বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালয়েশিয়ার পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে তুর্কি সরকার। ২০২২ সালে প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, বন সংরক্ষণ ও পরিবেশগত সহযোগিতাবিষয়ক পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষর করে এ দুই দেশ। ২০২৩ সালে তারা যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করা এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরদোয়ানের সফরকালে ইন্দোনেশিয়ায় ড্রোন নির্মাণকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে তুরস্কের বায়কার প্রতিষ্ঠান এবং ইন্দোনেশিয়ার রিপাবলিকর্প প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্ত দুই দেশের মধ্যে এ সমঝোতাকে ইতিবাচক বলে মূল্যায়ন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি রকেটসান, আসেলসান, হাভেলসান ও বায়কারের মতো তুর্কি প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া ২০২২ সালে ‘উচ্চপর্যায়ের কৌশলগত সহযোগিতা পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার প্রথম বৈঠক হয়েছে এ সফরের অংশ হিসেবে।

ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের যাত্রার তৃতীয় এবং শেষ গন্তব্য ছিল পাকিস্তান। পাঁচ বছর পর পাকিস্তান ভ্রমণ করলেন তিনি। তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কও বেশ দৃঢ়। তুর্কি সরকারের মতে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে পাকিস্তান তাদের মধ্যম পরিসরের প্রতিরক্ষা অংশীদার। পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তুরস্ক দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ সফরের দরুন পাকিস্তান তুরস্কের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার আওতায় তারা ইলেকট্রনিক যুদ্ধবিমান কেনার সুযোগ করে নিয়েছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এমনিতেই ঐতিহাসিকভাবে বেশ পোক্ত। এ চুক্তির মাধ্যমে যৌথ উৎপাদন এবং প্রযুক্তি ও অস্ত্রের বিকিকিনির সুযোগ আরও বৃদ্ধি পেল। আসেলান ও রকেটসানের মতো তুর্কি প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলো পাকিস্তানের অংশীদারদের সঙ্গে মিলে অত্যাধুনিক অস্ত্র উৎপাদন, পাকিস্তানের নিজস্ব সামরিক উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পশ্চিমা সরঞ্জামের ওপর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এ সামরিক সহযোগিতা তুর্কি-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে। পাশাপাশি পাকিস্তানের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে তুরস্কের অবস্থান আরও শক্ত করে তুলেছে।

সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য পশ্চিম দিক থেকে কিছুটা পূর্ব দিকে ঝুঁকছে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক রাজনীতির ধারায় পরিবর্তন আসছে। অন্যান্য মহাদেশেও প্রস্তুত করা হচ্ছে এশিয়ামুখী নতুন পরিকল্পনা। এসব পরিবর্তন আঙ্কারাকে বাধ্য করছে বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ করে এশিয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে। তারই অংশ হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস চালাচ্ছে তুরস্ক। আর এ অঞ্চলের দেশগুলোও তার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে। তবে তুর্কি সরকার এ বিষয়ে অবগত যে, এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ চর্চায় একাধিক পক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই তার কৌশলগত লক্ষ্যগুলোকে অর্জন করতে হলে এ অঞ্চলের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক গতিশীলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। প্রতিটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে নেতৃত্ব পর্যায়ে ব্যক্তিগত কূটনীতির সুযোগ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাবিষয়ক উদ্যোগ এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলোকে হাতছাড়া করা চলবে না। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ তুরস্ককে সুযোগ করে দেবে এশিয়ায় তার কাঙ্ক্ষিত প্রভাব বিস্তার করার। তবে রাজনৈতিক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওপর তুরস্কের নীতি অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না; বরং দুই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সম্পর্ককে টেকসই রূপ দিতে হবে।

লেখক: তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। নিবন্ধটি আরব নিউজ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এসিআই-এ নিয়োগ, আবেদন করুন অনলাইনে

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

বসতভিটা ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি, সন্তানের বিরুদ্ধে বাবার মামলা

ব্রাজিলের মন্ত্রীর মার্কিন ভিসা বাতিল, দায়িত্বজ্ঞানহীন বললেন লুলা

ভিপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে রুমমেটকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ, কী বললেন প্রক্টর

শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বৃদ্ধ আটক

২৭ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

২৭ আগস্ট : টিভিতে আজকের খেলা 

আজ থেকে নতুন দামে বিক্রি হবে স্বর্ণ

২৭ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১০

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১১

কৃষিবিদ আসাদুজ্জামান কিটোনকে সংবর্ধনা দিল এ্যাব

১২

মাছ ধরার নৌকায় মিলল সাড়ে ৪ লাখ পিস ইয়াবা, আটক ৯

১৩

ভোলায় নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল / এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

১৪

যৌথ বাহিনীর অভিযানে অনলাইন জুয়া চক্রের ২ সদস্য আটক

১৫

জেলেরা হেলমেট পরে মাছ ধরেন যেখানে

১৬

বিমানবাহিনীর আন্তঃঘাঁটি স্কোয়াশ প্রতিযোগিতা সমাপ্ত

১৭

স্পেনে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

১৮

কারাগারে সন্তান জন্ম দিলেন হত্যা মামলার আসামি

১৯

সিলেটের সাদাপাথর লুটের ঘটনায় সিআইডির অনুসন্ধান শুরু

২০
X