আজ যিনি পূজিত হচ্ছেন ধরাধামের আনাচে-কানাচে, সেই শিশুটি বাংলা ১১৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কচুয়াধামে। ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৭ বাংলা সালে বারদীর গোঁসাই নামে খ্যাত লোকগুরু বাবা লোকনাথ দেহ রেখেছেন বারদীতে। বারদী আজ রূপান্তরিত হয়েছে ‘মহাপীঠস্থান বারদী ধামে’। ধন্য বারদী। এরই মধ্যে আমাদের জীবনপাতা থেকে বিয়োগ হয়েছে ১৩৫টি বছর।
মহাপীঠস্থান বারদীধামসহ সমগ্র বিশ্বে ১৯ জ্যৈষ্ঠ তিরোধান দিবস স্মরণে সমারোহে মঙ্গল উৎসবের আয়োজনের প্রস্তুতি পর্ব চলছে। প্রতিবারের মতো এবারও স্বামীবাগে বাবা লোকনাথের আশ্রম থেকে বাবার অশেষ করুণায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে স্মরণিকা ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’। শ্রদ্ধাঞ্জলির মাধ্যমে স্বল্পপরিসরে হলেও লোকনাথ অনুরাগী ভক্তপ্রাণ সুধী-সজ্জনমণ্ডলী তাদের চিন্তা-চেতনার অভিব্যক্তি প্রকাশের সুযোগ হয়।
এই মাহেন্দ্রক্ষণের ক্ষীণতম সুযোগে যদি কিছু লেখা যায় তারই ক্ষুদ্র প্রয়াস—
দেহ-দেহী সম্পর্কে বাবা লোকনাথের ভাবনা: ‘দেহটাকে মাঠে ফেলিয়া দিতে পার। তাহাতে শৃগাল, কুকুর ও শকুনদের অন্তত এক বেলার আহারের সংস্থান হইবে’; সেবাধর্মের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ সৃষ্টি করলেন নিজের দেহদানের মাধ্যমে। কিন্তু ভক্তদের কাতর ক্রন্দনে বাবা দেহটিকে অগ্নিতে দগ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। যে দেহ ক্ষণস্থায়ী সেই দেহকে পরিচর্যা ও পরিপাটি রাখার জন্যই আজ কত কত আয়োজন। দেহাকর্ষণ থেকে চলছে লোভের ছড়াছড়ি আর দেহটিকেই বাবা কীভাবে সেবার কাজে বিতরণ করতে চেয়েছেন।
দেহী কী দেয়? সুখ, শান্তি, আনন্দ, প্রেম, শক্তি, জ্ঞান ও পবিত্রতা। অভাবে দেহ আসুরিক বৃত্তিসমূহ গ্রহণ করে। ফলে সেবা তার উৎকর্ষ সাধনে ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। ভোগাসক্তি ও স্বার্থসিদ্ধি সেবা ধর্মকে ম্লান করে দেয়। একবার ছবি তোলার জন্য অনেক অনুরোধের পরও বাবা রাজি হচ্ছিলেন না। ভাওয়ালরাজ রাজেন্দ্রনারায়ণ তখন বাবাকে বললেন, বাবা আপনি যখন থাকবেন না, কিছু গরিব মানুষ আপনার ছবি বিক্রি করে সংসার চালাতে পারবে। পরক্ষণেই বাবা ছবি তোলার অনুমতি দিলেন। সেবার মহান ব্রতের নির্দেশনা বাবা ভাওয়ালরাজের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে সচেতন করে দিলেন।
সেবার বিষয়ে-নিবেদিত প্রাণের অধিকারী হওয়া প্রথম পদক্ষেপ স্বার্থবুদ্ধি, আসক্তি-বুদ্ধি ও ভোগ-বুদ্ধি মানুষকে সেবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ফলে সেবাধর্ম তার নিজস্ব পথে চলতে ব্যর্থ হয়। সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন হাসপাতাল, উপাসনালয়, অনাথালয় ও বৃদ্ধাশ্রম যদি নিজস্ব নিয়মে চলে, তাহলে সেবার মান অটুট থাকবে। ব্যক্তিবিশেষ যদি স্বার্থ হাসিল করার প্রয়াস চালায়, তাহলে সেবা প্রতিষ্ঠান সেবার মান হারাবে। চিকিৎসক রোগীকে তার অর্থ উপার্জনের প্রত্যাশায় চিকিৎসা করবে, তখনই ব্যবসায়িক বৃত্তি চরিতার্থ হবে। উপাসনালয় পরিচালনা পর্ষদ যদি ভক্তদের মূল্যায়ন না করে সে ক্ষেত্রে সেবাধর্মের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।
সেবার ক্ষেত্রে মহাযোগী বাবা লোকনাথের ভাবনা—‘প্রতিদিন নিদ্রা যাবার পূর্বে কী কী শুভ আর কী কী অশুভ কাজ করেছিস হিসাব করো, পরের দিন অশুভকে ফেলে দিয়ে শুভকে ধরো।’
গীতায় বর্ণিত অভ্যাসযোগের কথাই বললেন অর্থাৎ আমরা এক দিনে বা রাতারাতি শুভ কাজ করতে পারছি না, সেজন্য বাবা বলেছেন, প্রতিদিন অভ্যাস করতে হবে যাতে মন্দ কাজ ফেলে দিয়ে—ভালো কাজটি ধরতে পারার অভ্যাস পড়ে। প্রদত্ত উপদেশ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য অন্ধকার থেকে আমাদের আলোতে বের হতে হলে ত্যাগ ও সেবার মহিমায়—জীবনকে আলোকিত করতে হবে।
বিশ্বকবির ভাবনায়—
দেশে ধন-সম্পদ কম থাকতে পারে, কিন্তু সাধন সম্পদের অভাব নেই। নিজকে জানাই বড় সাধনা-নিজকে জানার জন্য বাবা বলেছেন, ‘তোদের ভগবানের সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই, আমি দেখেছি আমাকে—আমি বদ্ধ আছি সংসারে আর সংসার বদ্ধ আছে জিহ্বা আর উপন্থে—যে এই দুটিকে সংযম করতে পেরেছে সেই সিদ্ধিলাভ করতে পেরেছে।’
ইসলামের দৃষ্টিতে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ইবাদত এবং মানুষের খেদমত করাই প্রকৃত সেবাধর্ম। খ্রিষ্টমতে, Service to Man, Service to God. তাই সত্য ও সুন্দরকে ধারণ না করলে সব ধর্ম ব্যর্থ। কোটি কোটি লোক আজ যিশুর জন্মদিন পালন করে, অথচ এ মহামানবকে লোহার পেরেক বিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছিল। দেহ যিশু চলে গেলেন বটে—রয়ে গেলেন সূক্ষ্মদেহী যিশু। দেহ যিশুর চেয়ে দেহী যিশু লক্ষ গুণ শক্তিশালী। আবার জেগে উঠল যিশু। কারণ সে সত্যকে ধরেছিল। ফলে তার মৃত্যু নেই, জন্ম নেই তিনি অজর অমর, সে অক্ষয়।
কোর্টে যখন কোনো কোনো অথবা কতিপয় সাক্ষী দাঁড়ায় তখন ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করেই বলে—আমি যাহা বলিব সত্য বলিব—আসলে মিথ্যা যখন দাঁড়ায়, তখন সত্যকে আশ্রয় করে অথবা তার পোশাক পরে দাঁড়ায়—সাময়িকভাবে হয়তো জয়ী হয় পরবর্তী পর্যায়ে সত্যের জয়জয়কার হয়। অনুরূপভাবে অমঙ্গলকে সমাজ সংসার চায় না, চায় না ভ্রান্ত ধারণায় চলতে। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন—
‘ঔষধটা তিতো কিন্তু কষ্ট করে সেবন করলে সুস্থ হওয়া যায়।’
পর পীড়নে যেমন সমাজে সংসারে কষ্ট আসে, তেমন পরোপকারে সমাজ সংসারে সুখ আসে। আসে শুদ্ধ চিত্তের বিকাশ—তখনই আত্মজ্ঞানের সম্যক উপলব্ধি আসে।
উপাসনালয় পরিচালনা কমিটির সেবা প্রধান প্রসঙ্গে বলা যায়:
কেউ আমরা শ্রমের মাধ্যমে সেবা করে থাকি—
কেউ অর্থের মাধ্যমে, কেউ মেধা ও সময়ের মাধ্যমে—
কিন্তু বিভেদের জায়গা: আমরা শ্রম, অর্থ, মেধা ও সময়কে যথানিয়মে যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে পারছি কি না, অর্থাৎ সঠিক কাজ সঠিক সময়ে, সেবার মান বজায় থাকল কি না। অর্থাৎ সর্বাগ্রে বিবেকের কাছে নিজেকে দাঁড় করানোর মানসিক প্রস্তুতি চাই।
যার যতটুকু সামর্থ্য অনুযায়ী সেবাব্রতের নিয়ম অনুশীলন সেবার মান বাড়াতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
মহাযোগী বাবা লোকনাথের অসীম করুণায় বাংলাদেশে ৪২৩টির অধিক বাবা লোকনাথের সংগঠন ও মন্দির তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেহ লোকনাথ—যতটা প্রকাশিত ছিল তার লাখো গুণ বেশি সূক্ষ্মদেহী লোকনাথ। লোকনাথ মহল বেড়ে চলেছে। সারা বিশ্বে স্ব-প্রকাশমান ধারায় বাবার চরণাশ্রিত ভক্তবৃন্দ সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায় ছুটে চলছে—
অন্তরে শ্রীগুরু রূপে থাকি সংগোপনে।
জ্বালাইব জ্ঞান দীপ প্রতি ভক্ত মনে॥
“সেবাকর্মের বিকল্প নেই, যেমন বিকল্প নেই—মা মাতৃস্নেহ-মাতৃদুগ্ধ-মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির।”
মন্তব্য করুন