বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নতুন রূপ “XFG” শনাক্ত হয়েছে, যা বিজ্ঞানীদের মতে একটি রিকম্বিন্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট—অর্থাৎ এটি পূর্ববর্তী দুই বা ততোধিক ভ্যারিয়েন্টের জিনগত উপাদান একত্রিত হয়ে তৈরি হয়েছে। এ ধরনের ভ্যারিয়েন্ট সাধারণত সংক্রমণ ক্ষমতায় তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয় হয় এবং দ্রুত বিস্তার লাভ করতে সক্ষম। এক্সএফজি ইতোমধ্যে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতও রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একে বর্তমানে ‘ভ্যারিয়েন্ট আন্ডার মনিটরিং’ হিসেবে বিবেচনা করছে, যদিও এটি এখনো ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ নয়।
তবে এর জিনগত গঠন এবং অতিমাত্রায় সংক্রমণ ক্ষমতা দেখে বিজ্ঞানীরা এটিকে ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। ভারতের পর বাংলাদেশে এ ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ায় জনমনে কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। আমরা অতীতে ডেল্টা ও ওমিক্রনের ভয়াবহ ঢেউ দেখেছি, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চরমভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল। তবে বর্তমানে আমাদের হাতে রয়েছে ভ্যাকসিন, মহামারিকালীন বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তুলনামূলকভাবে উন্নততর স্বাস্থ্য-প্রস্তুতি কাঠামো।
আত্মতুষ্টি নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন: যদিও এক্সএফজি এখনো গুরুতর অসুস্থতা বা হাসপাতালে ভর্তির হার বাড়াচ্ছে না, তবুও এটি অবহেলার সুযোগ তৈরি করে না। অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, নতুন ভ্যারিয়েন্টের দ্রুত বিস্তার মোকাবেলায় সময়োচিত ও সমন্বিত পদক্ষেপই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধক। এজন্য দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), স্বাস্থ্য বিষয়ক উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের কার্যকর সমন্বয় অপরিহার্য।
করণীয়সমূহ—
টেস্টিং ও জিনোম সিকোয়েন্সিং বৃদ্ধি: এক্সএফজি ভ্যারিয়েন্টের প্রকৃত বিস্তারের মাত্রা নির্ধারণে জরুরি হলো দেশজুড়ে নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ বাড়ানো। দ্রুত পর্যাপ্ত সংখ্যক শনাক্তকরণ কিট সংগ্রহ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সহজলভ্য করতে হবে। জিনোম সিকোয়েন্সিং সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনে আঞ্চলিক গবেষণাগারগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল তথ্য প্রচার: জনগণের মধ্যে আতঙ্ক নয়, বরং তথ্যভিত্তিক সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিতভাবে ভুল তথ্য, গুজব ও ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য রোধে নজরদারি জরুরি।
হাসপাতাল প্রস্তুতি ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ: যদিও হাসপাতালে এখনো ভিড় নেই, তবুও আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আইসিইউ শয্যা, অক্সিজেন, জরুরি ওষুধের মজুদ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও ওষুধ সরবরাহ ও রেফারাল ব্যবস্থা কার্যকর রাখতে হবে।
টিকাদান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা: যারা এখনো বুস্টার ডোজ নেননি, কিংবা বয়স্ক ও সহ-রোগে আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনতে হবে। বিশ্বব্যাপী টিকার চাহিদা বেড়ে গেলে যাতে সংকট না হয়, সেজন্য আগাম টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ পরিকল্পনা জরুরি।
আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও গবেষণা সহযোগিতা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), সিডিসি (CDC), ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন (ECDC) সহ সংক্রামক রোগের গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তথ্য ও গবেষণা সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর জিনগত পরিবর্তন এবং আচরণ বুঝতে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্গঠন: কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে সংক্রামক রোগ মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো, মানবসম্পদ ও গবেষণায় টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। পরিশেষে উল্লেখ যে, করোনাভাইরাস এখন একটি মৌসুমি ভাইরাসের মতো আচরণ করছে, যার নতুন নতুন রূপ স্বাভাবিকভাবেই আবির্ভূত হবে। তবে আতঙ্ক নয়, এর মোকাবেলায় প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক প্রস্তুতি, জনসচেতনতা এবং কার্যকর প্রশাসনিক সমন্বয়। সরকারকে অবশ্যই প্রমাণভিত্তিক, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেইসাথে নাগরিকদের উচিত হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা। মহামারির অভিজ্ঞতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে “স্বাস্থ্য নিরাপত্তা শুধু চিকিৎসকদের কাজ নয়, এটি আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব।”
লেখক: ফুল ফ্যাকাল্টি, রিসার্চ সেন্টার ফর গ্লোবাল অ্যান্ড লোকাল ইনফেকশাস ডিজিজেস, ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন, ওইতা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
মন্তব্য করুন