বগুড়ায় কিশোরী মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক রিকশাচালককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অন্তত এমন অভিযোগই পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক অনুসন্ধানে। এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও গর্হিত অপরাধ।
রোববার কালবেলায় প্রকাশিত খবর অনুসারে, গত শনিবার বিকেলে শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত শাকিল আহমেদ বগুড়া শহরের শিববাটি শাহি মসজিদ এলাকার সাজু মিয়ার ছেলে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শাকিল শিববাটি এলাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতেন। তার এক কিশোরী কন্যাকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তির বয়স বেশি হওয়ায় শাকিল বিয়ের প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। ঘটনার দিন দুপুরের দিকে ১০-১৫ জন বখাটে শাকিলকে বাড়ি থেকে ফুলবাড়ী এলাকায় করতোয়া নদীর ঘাটে নিয়ে যায়। সেখানে শাকিলকে বেদম মারধর করা হয়। পরে তাকে নদীর ঘাটে ফেলে পালিয়ে যায় বখাটেরা। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেয়েকে বিয়ে না দেওয়ায় শাকিলকে মারধর করে চাকুসহ পুলিশে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বখাটে যুবকদের। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের পুলিশ প্রশাসনের বরাতেই কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবর বলছে, রিকশাচালক শাকিলকে মারধরের পর ‘মব’ তৈরি করে পুলিশে সোপর্দ করার চেষ্টা করা হয়। পুলিশ তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
দেশে ‘মব’ সৃষ্টির মাধ্যমে হত্যার ঘটনা লক্ষণীয় পরিমাণে বেড়েছে, যা অত্যন্ত ভীতিকর। অপরাধীরা তাদের পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ সংঘটন করে। এরপর কোনো মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়ে উপস্থিত জনতাকে উসকে দেওয়া হয় এবং উন্মত্ত জনতা হামলে পড়ে টার্গেট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ওপর। নিষ্ঠুরভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ভুক্তভোগী। গত বছর আগস্টের পর চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছে। এ ছাড়া গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছে কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত ৭৬৫ জন। চলতি বছরের মার্চে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এসব তথ্য জানায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, গণপিটুনির ঘটনায় থানায় মামলা হলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের ঘটনা খুবই কম। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় না আসায় এ ধরনের ঘটনা থামছে না।
সাধারণত ডাকাত, চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এসবের বাইরে ধর্মীয় অবমাননা এবং ছেলেধরার অভিযোগেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। তবে সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে, কাউকে পিটিয়ে মারার কারণ হিসেবে ব্যক্তি-শত্রুতা কিংবা রাজনৈতিক মতবিরোধের মতো ঘটনাও। বগুড়ায় এ ঘটনার যে দিকটি খুবই ভয়ংকর, তা হচ্ছে ‘মব’-এর অতিস্বাভাবিকীকরণের প্রবণতা। একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকাকে বিয়ের প্রস্তাব খুব স্বাভাবিকভাবে বাবা প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রাপ্তবয়স্ক হলেও প্রত্যাখ্যানের অধিকার তার রয়েছে। এমন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় বাবাকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হলো এবং এই হত্যা ‘মব’-এর নামে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেল।
আমরা মনে করি, যত্রতত্র ও যে কোনো বিষয়ে চূড়ান্তভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া সমাজের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধিরই বহিঃপ্রকাশ। আর অপরাধপ্রবণতা তখনই বৃদ্ধি পায়, যখন অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তির আওতায় না আসে; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থাকে দুর্বল; আইনের শাসন ও জবাহদিহির চর্চায় থাকে নাজুকতা। আমাদের প্রত্যাশা, বগুড়ার এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
মন্তব্য করুন