১৫ জুন বিশ্ব বাবা দিবস। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকে যার শুরু। ১৯০৯ সাল। সোনোরা স্মার্ট ডোড নামে এক আমেরিকান নারী বাবা দিবস প্রতিষ্ঠা এবং ওই দিন সরকারি ছুটি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়ে মাঠে নামেন। ডোডের বাবা স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ছয় সন্তানকে লালন-পালন করেন। ডোড চিন্তা করলেন, মায়েদের মতো বাবাদেরও সম্মান জানানো উচিত। তিনি এক বছর ধরে একটি পিটিশনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১০ সালের ১৯ জুন ডোডের জন্মরাজ্য ওয়াশিংটনে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস উদ্যাপন করা হয়।
‘বাবা’ শব্দটি তুর্কি ভাষা থেকে এসেছে। তবে এটি বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত হয় এবং বিভিন্ন ভাষায় এর সমার্থক শব্দ রয়েছে। যেমন- সংস্কৃত ভাষায় বাবাকে ‘পিতা’ বা ‘জনক’ বলা হয়, আর উর্দুতে ‘আব্বা’। ‘বাবা’ শব্দটি শিশুদের প্রথম শব্দগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা সাধারণত ‘মা’ শব্দের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়।
বাবা শব্দটি কারও কাছে বটবৃক্ষ। কারও কাছে মাথার ওপর বিশাল একটা ছাদের মতো কিংবা তপ্ত রোদে এক টুকরো মেঘ। কারও কাছে বাবা মানে ঈদ, বাবা মানে পৃথিবী- কত কিছুর সঙ্গেই না আমরা এর তুলনা করতে যাই। আসলেই কি বাবার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয়! স্বাভাবিকভাবেই না। এগুলো নিছক কিছু শব্দমাত্র। বাবার তুলনা বাবা নিজেই। এ এক সংজ্ঞাহীন শব্দ।
আমার বাবাকে নিয়ে কিছু কথা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আমার বাবার বয়স প্রায় ৯০ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে খাবার এবং প্রাকৃতিক কার্যক্রম সম্পাদন ব্যতীত বাকি সময় বাবা শুয়ে থাকেন। এ লেখাটি আমি যখন লিখছি আজ শনিবার ১৪ জুন, সকালে অফিসে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা আমার মাকে বলতেই বাবা বলেন, তোমার অধীনস্থ সবাই আজকে ছুটিতে আছে, তুমি একা একা অফিসে যেও না, বাসায় কম্পিউটার এবং টেলিফোনে অফিসের কাজগুলো করে নিও। আজ লাঞ্চ করতে বসতেই বাবা বলেন, তুমি যে মলা মাছ কিনে নিয়ে আস দামাদামি করেছ? তোমার তো অভ্যাস বাজারে গেলে যে যা বলে তাই দাম দিয়ে চলে আস, কবে যে তুমি চালাক-চতুর হবে।
আমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন বাবার একটি কথা উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে। আমি তখন নোয়াখালী জেলা স্কুলে পড়াশোনা করি। আমার বাসা বিদ্যালয় থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরবর্তী ছিল। বিদ্যালয়ের বার্ষিক আন্তঃফুটবল টুর্নামেন্ট বাসার নিকটবর্তী আহমদীয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভেনু ছিল। খেলা শুরু হওয়ার ৬ মিনিট ব্যবধানে নোয়াখালী জেলা স্কুল প্রতিপক্ষকে গোল দেয়, ওখানে জেলা স্কুলে সমর্থক কম থাকার সুযোগে প্রতিপক্ষ মাঠে নেমে গোলরক্ষককে তেড়ে আসতে উদ্ধত হয়। আমার স্কুলবন্ধু সবুজ, তৎকালীন নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সন্তান, আমরা একে অপরের হাত ধরে মাঠে নেমে চিৎকার করে বললাম, জেলা স্কুলের একজন প্লেয়ারের গায়ে টোকা পড়লে, আগামী পরশু তোমাদের বিদ্যালয় খেলা কিন্তু জেলা স্কুলে রয়েছে, তখন সব গেট বন্ধ করে সবগুলাকে বেধে পেটাবো।
আমরা দুই বন্ধু দুই পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিতে লাগলাম,সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের গোলের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, অবশেষে ৩ শূন্য গোল ব্যবধানে বিজয়ী বেশে আমরা মাঠ ছাড়ি। আমার বাসা ওই বিদ্যালয়ের পাশে হওয়ায় আক্রমণের শিকার হতে পারি মর্মে পুলিশ নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকে তিনদিনের জন্য নোয়াখালী জেলা স্কুলের শিক্ষক হোস্টেলে সপর্দ করে। আমার বাবা এ ঘটনায় আমার উপর রাগ না করে, আমাকে দেখা মাত্রই বলে আমার ছেলে যেন সম্রাট আকবর-বাবর-শাহজাহান এর মত লিডার হয়, আমি আল্লাহর কাছে এই ফরিয়াদ করি।
আরেকটি ঘটনা শেয়ার করি। শিশুকালে কিছুদিন আমি মায়ের সঙ্গে গ্রামে ছিলাম। গ্রামের মক্তবে কয়েকদিন গিয়ে আমি যাওয়া বন্ধ করে দেই। কারণ দুইটি, প্রথমত একজন ভুল করলে হুজুর গণহারে সবাইকে দুই বেত করে মেরে শাস্তি প্রদান করে। দ্বিতীয়ত খুবই চিৎকার করে পড়তে বলে। যা আমার অপছন্দ ছিল। একদিন সকালে মা আমাকে মক্তবে পড়তে না যাওয়ায় খুব বকা দিয়েছে, আমি রাগ করে নাস্তা করছি না। আমার বাবা আমার মাকে বলে আমার ছেলেকে বকা দিয়েছো কেন ? আমার মা বলেন, তোমার আস্কারা পেয়ে ছেলে হচ্ছে আস্ত একটা বাদর। বাবা উত্তর দিলেন আমার এই ছেলে কখনোই খারাপ হবে না, তোমাকে এত ভাবতে হবে না ওকে নিয়ে।
বাবা আমাকে কোলে নিয়ে আমার চোখ মুছে পার্শ্ববর্তী বাজারে নিয়ে সকালবেলা গরম পরোটা খাওয়ালেন। আমার বাবা অদ্যাবধি কখনো আমার গায়ে হাত তোলেন নাই। আমাদের পরিবারে সবাই বাবাকে বাঘের মত ভয় করে। একমাত্র আমি বাবার হাত ধরে, পা ধরে, কখনো মাথা ধরে টানাটানি করি। আমার বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন। কমসে কম যেন শতবর্ষী হয়। বাবা সব সময় আমাকে একটি কথা বলে, ‘কখনো জীবনে হাল ছাড়বেনা, সব সময় শেষ পর্যন্ত দেখে যাও কি ঘটে।’
একজন বাবা তার সন্তানের জন্য কতভাবে অবদান রেখে যায়, তার হিসাব কেউ কখনো দিতে পারবে না। আজ হয়তো তার সক্ষমতা আছে। তিনি আমাদের আগলে রাখছেন। কিন্তু তার দুঃসময়ে আমাদের উচিত তার পাশে থাকা, সেবা করা। কারণ স্বার্থ ছাড়া কেউ যদি আমাদের ভালোবাসেন তিনি হলেন বাবা। বাবা ছাড়া প্রত্যেকটা দিন-রাত খুব একা লাগে। তার স্পর্শটুকু, সেই মায়াভরা ডাক অথবা মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া মনে পড়ে। বাবা বেঁচে থাকতে কোনোদিন ভাবিনি বাবাকে ছাড়া থাকতে হবে।
যাদের বাবা বেঁচে নেই, কেটে যাচ্ছে একেকটি দিন, মাস আর একেকটি বছর- বাবা নেই, আছে বাবার রেখে যাওয়া হাজারো স্মৃতি, একটা সময় সবার জীবনেই আসে যখন মানুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তখন কারও পরামর্শ খুব জরুরি হয়ে পড়ে। সে সময়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো আদর্শ একজন মানুষ হলেন বাবা। স্বভাবগত গাম্ভীর্যের জন্য বাবার সঙ্গে সবার ঘনিষ্ঠতা একটু কম থাকে। কিন্তু সে মানুষের আমাদের প্রতি ভালোবাসার কোনো ঘাটতি থাকে না। বাবা একটা বটগাছের মতো সব সময় ছায়া দেয়, আজ যার বাবা নেই তাই তার ছায়াটাও নেই। সে এক অভাগা, যে কখনো তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারবে না, ‘বাবা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’
বাবা তুমি না থাকলে জীবনটা এতো সহজ হতো না। বাবার ত্যাগ আর পরিশ্রমের ফলেই আজ আমরা সুখী। তোমার কাঁধে চড়ে পৃথিবীকে দেখেছি। যদিও সময় আর দূরত্ব আমাদের আলাদা করেছে, আমাদের আলাপচারিতা এখন মুঠোফোনেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবুও তোমার নির্দেশিকা, পরামর্শ ও ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে তোমার স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটছি। তুমি ছাড়া জীবন অচল, নিঃসঙ্গ যাত্রায় প্রতিটি মুহূর্ত নির্জন। আঙুল ধরে হাঁটতে শেখা হোঁচট খাওয়াও আছে, যখনই জীবনে মুখ থুবড়েছি বাবা তুমি ছিলে পাশে। সেবার স্পর্শে আগলেছো রোজ কপালে দিয়ে আদর, মা বলত তোমার আস্কারাতেই হয়েছি আস্ত বাঁদর।
আবদার মেটানোর সব চেষ্টায় দিয়েছো নিজ শখের বলি, তোমার শেখানো মিতব্যয়ী পথে আজ আমিও যে চলি। চাকরি ও পড়াশোনার সূত্রে বহুদূরে আজ পরিশ্রমের মানে বুঝি, কাজের চাপে ভেঙে পড়া কাঁধে তোমার হাতটা খুঁজি। যদি কখনো মনে জাগে কোনো নায়কের প্রতি শ্রদ্ধা, মনে রেখো তবে বাবার অপর নাম অলিখিত যোদ্ধা।
বাবা শুধু একজন মানুষ নন। একটিমাত্র সম্পর্কের নাম নয়। বাবার মাঝে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুত মায়াবী প্রকাশ। যার হাত ধরে রাস্তায় প্রথম হাঁটতে শিখেছি তিনি হলেন বাবা। সেই ছোট্টবেলা থেকে আজ পর্যন্ত বাবার কাছে যা আবদার করেছি তিনি তার সাধ্য দিয়ে সেসব পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই একমাত্র আশ্বাস, ভরসা যিনি দিতে পারেন তিনি হচ্ছেন বাবা। এই পৃথিবীতে একমাত্র বাবাই এমন এক ব্যক্তি যে নিজের চেয়ে নিজের সন্তানকে এগিয়ে যেতে দেখতে চায়। আসলে দু-এক কথায় বাবার বর্ণনা শেষ করা যাবে না।
বাবার ঋণ কখনো শোধ করতে যেও না, কারণ সাগরের জল সেচে কখনো শেষ করা যায় না। তাই সব সময় একটা কাজ করে যেও; সেই ছোট্টবেলা থেকে বাবা তোমাকে যেভাবে আগলে রেখেছে তুমি বড় হলে তাকে সেভাবেই আগলে রেখ। বাবা কে নিয়ে লিখতে গেলে আমার কলমের কালি থমকে যাবে তবুও ফুরাবে না, বাবা কে নিয়ে লেখার মতো অনুভূতি আমার জানা নেই- তবুও লেখার খাতিরে লিখতে হয়। আমার বাবা আমার কাছে বটবৃক্ষের মতো এক বিশাল ছায়া, সত্যি বলতে আমার বাবা ছাড়া আমার এতদূর আজ এই যে পথ, যতটুকু এসেছি এটা এতো সুন্দর শান্তিতে হয়তো আমার জন্য হতো না। কারণ, আমি ছিলাম একটা যানবাহন মাত্র- আমার পথ দেখিয়ে মনুষ্য করা মানব মানুষের সংস্পর্শে আসা সবই বাবার হাত ধরেই। বাবাকে নিয়ে লেখার কোনো শেষ নেন, আমার বাবা আমার কাছে এক সেরা মানুষ, একটা আদর্শ।
পরিশেষে ছোট্ট এই ছড়াটি লিখে এবং পৃথিবীর সব বাবা-মা ভালো থাকুন- এই প্রত্যাশা করে এ প্রবন্ধের ইতি টানছি।
বাবা হলো আমার এই জীবনে
আমার হাজার সুখ।
বাবা হলো আমার কাছে
হাসিমাখা মুখ।
বাবা হলো আমার যত
দুঃখের সমাধান।
আমার বাবা এ জীবনে সুরে ভরা গান।
বাবা আছে স্বপ্নও আছে,
বাবা হলো স্বপ্ন আশা পূরণ করার চাবি।
বাবা আমার মাথার উপর বট বৃক্ষের ছায়া,
বাবা আমার এ জীবনে আদর স্নেহ ও মায়া।
বাবা থাকায় জীবন আমার সুখ মোড়ানো চাদর,
একবার চলে গেলে পাব না আর,
আমার বাবার আদর।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল
মন্তব্য করুন