বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিনের নীতিগত এলোমেলো অবস্থা ও বৈশ্বিক চাপ সত্ত্বেও এখন একটি স্থিতিশীল গতির দিকে এগোচ্ছে। করোনা-পরবর্তী ধস, বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতের মাঝেও কিছু সূচকে ইতিবাচক অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো জাগাচ্ছে।
ব্যাংক খাতে নীতিগত সংস্কার: ভরসার নতুন ভিত্তি: বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি যুগোপযোগী সার্কুলার জারি করেছে, যেখানে সুপরিচালিত ব্যাংকগুলো—যাদের মন্দ ঋণের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে, তাদের অধিকতর লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আগের সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেওয়ার অনুমতি থাকলেও এখন সেই সীমা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে গ্রাহকের আস্থা বাড়বে এবং আমানতের পরিমাণে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে।
অন্যদিকে, দুর্বল ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর বিষয়ে এখনো কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। পূর্ববর্তী সরকারগুলো অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিদের ব্যাংক লাইসেন্স দিয়েছে, যার ফলে ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। তবে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এসব অনিয়ম অনেকটাই কমেছে এবং একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে।
আর্থিক নীতি ও সুদের হার: বাস্তবতাভিত্তিক পুনর্মূল্যায়ন বাংলাদেশে রেপো রেট বা নীতিনির্ধারক সুদের হার দীর্ঘ সময় ছিল ১০ শতাংশের ওপর, যা অনেক দেশের তুলনায় ব্যতিক্রমী। ক্ল্যাসিকাল অর্থনীতিতে উচ্চ সুদের হারকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়, তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এ নীতির কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগে স্থবিরতা তৈরি করেছে, যা অর্থনীতির সামগ্রিক গতি মন্থর করে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে ট্রেজারি বন্ডে সুদের হার কিছুটা কমে আসায় আশা করা হচ্ছে, সামনে ঋণের খরচও কমবে এবং ব্যবসা-বিনিয়োগে গতি ফিরবে।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি: অর্থনীতির চালিকাশক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় দুটি স্তম্ভ হচ্ছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিট্যান্সে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে—যেখানে মাসিক প্রেরিত অর্থ দুই বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে আড়াই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানিপণ্যের চাহিদা বাড়ায় রপ্তানি আয়ে উন্নতি হয়েছে। এ দুই উৎসের ওপর ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা ফিরতে পারে। পুঁজিবাজারে বাস্তব বিনিয়োগের উত্থান শেয়ারবাজার একসময় ‘জুয়ার মাঠ’ হয়ে উঠেছিল, যেখানে অধিকাংশ লেনদেনই ছিল মার্জিন লোননির্ভর এবং স্বল্পমেয়াদি লাভের আশায় পরিচালিত। তবে বর্তমানে লেনদেনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হলেও, অধিকাংশ বিনিয়োগ এখন প্রকৃত এবং দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিনের গড় লেনদেন ৪০০-৫০০ কোটি টাকার মধ্যে থাকলেও এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের।
এ ছাড়া সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আইপিও নীতিমালা সংস্কার করছে এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। মেট লাইফ, নেসলে, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যদি মুম্বাই বা করাচিতে তালিকাভুক্ত হতে পারে, তবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেও তাদের উপস্থিতি সম্ভব; প্রয়োজন যথাযথ করছাড় ও প্রণোদনার। প্রাইভেটাইজেশন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের দক্ষ ব্যবহার সরকারের হাতে থাকা বহু লাভজনক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এখনো বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ইউনিলিভার, ইস্টার্ন কেবলস বা ওসমানি গ্লাসশিটের মতো প্রতিষ্ঠানে সরকারের অংশীদারত্ব প্রাইভেট সেক্টরের হাতে ছেড়ে দিলে এসব সম্পদ আরও দক্ষভাবে ব্যবহৃত হবে এবং সরকার রাজস্ব আয়ের নতুন উৎস পাবে।
মার্জিন লোন: বন্ধ নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত মার্জিন লোন। ব্যবস্থাটির দুর্বলতা অনেক সময় শেয়ারবাজারের অস্থিরতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটিকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ না করে এর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা অধিকতর যৌক্তিক। বিশেষ করে লোন-টু-ভ্যালু রেশিও হ্রাস এবং মনিটরিং জোরদার করে এ ঝুঁকিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন করে প্রাণ ফিরে আসছে। প্রবাসী আয় ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের সংস্কার, বিনিয়োগে ইতিবাচক পরিবর্তন এবং পুঁজিবাজারে বাস্তব বিনিয়োগ—এ চারটি শক্তির ওপর ভর করে দেশ একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সুশাসন ও কার্যকর নীতিমালা। হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই; বরং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
লেখক: ব্যাংকার ও গবেষক
মন্তব্য করুন