ড. সেলিম জাহান
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের খোলস

মানুষের খোলস

বছর দশেক আগের কথা। তখন রুজভেল্ট দ্বীপে থাকি আমি। সেদিন সন্ধ্যা নেমেছিল বেশ জমকালোভাবে। হাঁটতে বেরিয়েছিলাম আমাদের দ্বীপটিতে। হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম একেবারে উত্তরের বাতিঘর পর্যন্ত। ছলাৎ ছলাৎ করে জলের শব্দ, আকাশে গাঙচিলদের ক্যাঁক ক্যাঁক চিৎকার, উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া মিলিয়ে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ বাদে চমক ভাঙল। লক্ষ করলাম, সারা বাতিঘর এলাকায় আমি একা, আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে এবং সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। উল্টোমুখো হয়ে আবার বাড়ির পথ ধরলাম।

বাতিঘরের ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময়ে সেই ঘনায়মান অন্ধকারে চোখ গেল একটি বার্চ গাছের গোড়ায়। না, এমন কিছু নয়; ঘাসের ওপরে একটি সাপের খোলস পড়ে আছে। দেখে মনে হলো সাপটি যেন এইমাত্র খোলসটি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। কেমন যেন গা শিরশির করা শীতল একটা অনুভূতি মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল। কেন জানি দ্রুত পা চালালাম জায়গাটা পেরিয়ে যেতে।

হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, আসলে সাপের মতো মানুষেরও তো খোলস আছে। সাপ খোলস ছেড়ে চলে যায়; মানুষ খোলস ধারণ করে থাকে। সাপ খোলস ছেড়ে নিজেকে প্রকাশ করে, মানুষ খোলস ধরে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। সাপ খোলস বদলায় প্রতি বছর, মানুষ খোলস ধরে রাখে সারা জীবন। সাপের খোলস বলা যায় কেমন হবে, মানুষের খোলসের অগ্রকথন সম্ভব নয়। কত রকমের খোলস ধরে মানুষ—ভালো মানুষীর, ভদ্রতার, মানবিকতার। আবার অনেক সময়ে নানান কৃত্রিম আবরণে ঢেকে থাকার কারণে বহু মানুষের মানবিক রূপটি আমরা দেখতে পাই না—তাও তো সত্য।

নিজেকে লুকিয়ে রেখে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনবরত ভালো মানুষীর খোলস ধরতে দেখি মানুষকে। ভালো মানুষ সেজে অন্যের ক্ষতি করতে মানুষের জুড়ি নেই। যে মানুষটি বন্ধুত্বের খোলস ধরে হাত বাড়ায়, তার অন্য হাতে যে শানিত ছুরি, তা অনেক সময় আমরা দেখতে পাইনি। আস্থাভাজনের আবরণে যে নির্ভরতার আশ্বাস দেয়, বিশ্বাসভঙ্গ করতেও তার আটকায় না। যাকে দেবতুল্য মনে হয়, তার খোলস খুলে গেলে তাকে শয়তানেরও অধম মনে হয়। আমার এক অপরাধবিজ্ঞানী বন্ধু একবার আমার বলেছিলেন, সবচেয়ে পাকা ও জঘন্য অপরাধীদের মুখে, চালচলন, ব্যবহারে এমন একটা খোলস থাকে যে তাদের আর পাঁচজন থেকে তো আলাদা করাই যায় না, বরং তাদেরই সবচেয়ে ভালো মানুষ বলে মনে হয় আপাতদৃষ্টিতে। তারপর এ জাতীয় মানুষদের দ্বারা সংঘটিত কিছু অপরাধের তিনি বিবরণ দিয়েছিলেন। সেসব অপরাধের ন্যক্কারজনকতা আর বীভৎসতায় শিউরে উঠেছিলাম।

ভদ্রতার খোলস যে কত দেখেছি। প্রচণ্ড বিরক্তি কারও প্রতি কিন্তু দেখা হলেই উষ্ণ করমর্দনের সঙ্গে বলেছি, ‘কী যে ভালো লাগল, আপনাকে দেখে।’ সহকর্মীর পিতৃবিয়োগ ঘটেছে, কিচ্ছু আসে যায় না আমার তাতে, কিন্তু চিঠি লিখে শোকে মুহ্যমান এ ব্যক্তিটিকে বলছি, ‘কী যে দুঃখ পেয়েছি আপনার এ অপূরণীয় ক্ষতিতে। আন্তরিক সমবেদনা জানবেন।’ পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর পুত্রটি পরীক্ষার প্রথম স্থান অধিকার করেছে, হিংসায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু সবার সামনে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে বলছি, ‘এ হচ্ছে আমাদের গর্ব।’ বড়দের ভদ্রতার মেকি খোলস সবচেয়ে বিভ্রান্ত করে শিশুদের এবং তাদের সরলতার অপমৃত্য ঘটে ওখানেই। ভদ্রতার খোলস আবার শ্রেণি বিভাজনের ওপর নির্ভর করে। আমাদের ভদ্রতার মেকি খোলসটা খুলে যায় যখন আমরা দরিদ্র শ্রেণির সঙ্গে কথাবার্তায় রত হই। মানবিকতার খোলসটি বেশি দেখা যায় গোষ্ঠীগত জীবনে। নিপীড়িত মানুষের জন্য কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার পর বহু মানুষকে দেখি পাঁচতারা হোটেলের ভোজন কক্ষে। ধর্মের মানবতার কথা শেষে নানান দুর্নীতি আর ন্যক্কারজনক কাজে লিপ্ত হন ধর্মীয় নেতারা। ধর্মীয় খোলসের বর্ম তো বারবার ব্যবহৃত হতে দেখেছি নানান সমাজে, নানান ধর্মে। মানবতার নামে, মানবিকতার খোলসে কত জায়গায় কত অর্থ তোলা হয়েছে, হিসাব মেলেনি সেসব সম্পদের নানান সময়ে। কুম্ভীরাশ্রু হচ্ছে মানবিকতার খোলসের বড় অস্ত্র। কিন্তু মানুষের আবরণের আরেকটি সুন্দর দিকও তো আছে—আবরণই বলা চলে তাকে। অনেক মানুষ আছেন, যারা আপাতদৃষ্টিতে রাগী মানুষের আবরণ পরে থাকেন, কিন্তু অন্তরের ভেতরে তাদের মমতা আর স্নেহের ফল্গুধারা বয়ে যায়। আমার এক বাহ্যত হেঁয়ালি-খেয়ালি বন্ধু আছে, যার হৃদয়টা বুঝতে পারলে একজন অত্যন্ত মমতাময় অনিন্দ্যসুন্দর মানুষের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু ওটা ভেতরের, বাইরের নয়; ওটা ছুঁতে পারার, দেখার নয়; ওটা বোধের, প্রকাশের নয়। বহু গুণীকে দেখেছি যে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন, নির্গুণের আবরণ পরে থাকেন। যখন তাদের লুকিয়ে রাখা গুণের একটু নিদর্শন পাই, তখন হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না।

বহুকাল আগে আমাদের এক সহকর্মীর বাড়িতে এক নৈশভোজের আমন্ত্রণ ছিল। ভোজ শেষে কফির কাপ হাতে আমরা সবাই বসার ঘরে। সেখানে গৃহকর্ত্রী জানালেন যে, আমাদের জার্মান সহকর্মীটি চমৎকার পিয়ানো বাজান। তিনি সরাসরি অস্বীকার করলেন। কিন্তু জনতা তাকে ছাড়বে কেন? অনেকটা টেনেহিঁচড়ে তাকে পিয়ানোর সামনে বসিয়ে দিল বন্ধুরা। আধা মিনিটের মধ্যেই বোঝা গেল যে, এ পাকা হাত। বাজালেন মিনিট পাঁচেকের মতো বেটোফেনের ‘ফ্যুর এঁলিস’। সারা ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। বাজনা যখন শেষ হলো, তখন বহুক্ষণ আমরা কথা বলতে পারিনি—এমনই ছিল তার বাদনের অনুরণন। নির্গুণের আবরণে নিজেকে ঢেকে রেখেছিলেন তিনি কতকাল আমাদের কাছে।

চূড়ান্ত বিচারে মানুষ হয়তো আসলেই খোলস। এই যে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে নানান মানুষ আছে—তার আধার তো নানান খোলসই বটে। তাই হয়তো প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ‘আমার মাঝের আসল আমিটি উঠে দাঁড়াবেন কি?’ আর মাঝেমধ্যে ওই যে সেই গানটি হৃদয়ের কোনো এক গহিন কোণ থেকে উঠে আসে—‘হায় রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলেই ঠুস’—তখন নিজেকে একটা খোলস ছাড়া কীই-বা ভাবা যায়?

লেখক: ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আগামী ৫ দিন আবহাওয়া কেমন থাকবে, জানাল অধিদপ্তর

আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে আবারও ধাক্কা খেল বাংলাদেশ 

অর্থ আত্মসাৎ : বিএনপি নেত্রী আফরোজার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা অনুমোদন

প্লট দুর্নীতি  / শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের বিরুদ্ধে তিন বাদীর সাক্ষ্য শেষ

গণপিটুনিতে জামাই-শ্বশুর নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৪

ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে যুবক আটক

মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লের প্রধান উপদেষ্টা 

ভারতে ভুয়া পুলিশের অফিসে আসল পুলিশের হানা

আমরা মরলে অর্ধেক দুনিয়া সঙ্গে নিয়ে যাব, যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান

ঘরে বসে সহজ পদ্ধতিতে কিডনির পরীক্ষা করতে পারবেন

১০

ভারতে রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আটক

১১

যুবকদের বড় সুখবর দিল সরকার

১২

ফিলিস্তিনিকে স্বীকৃতি / বাড়তি নজর কাড়ছে নিউজিল্যান্ড

১৩

মহাসড়ক বন্ধ করে নবীনবরণ অনুষ্ঠান

১৪

ওয়ানডেতে রোহিত-কোহলির খেলা নিয়ে যা বললেন গাঙ্গুলি

১৫

পল্লবী থানা হেফাজতে জনি হত্যা : দুই পুলিশ কর্মকর্তার যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল

১৬

গানের টিজারেই ঝড় তুললেন হৃতিক আর জুনিয়র এনটিআর

১৭

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস জিনিয়াসে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সাফল্য 

১৮

মিরপুরে পিচ পরিদর্শনে হেমিং, চোখে পড়ল ‘পুঁই বাগান’

১৯

ত্বকের যেসব লক্ষণে বুঝবেন শরীরে কোলেস্টেরল বাড়ছে

২০
X