সব মানুষ সমভাবে সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ এমন কিছু অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, যা কখনো কেড়ে নেওয়া যায় না। যেমন—জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং সুখের সন্ধানের অধিকার (যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৭৭৬)।
আজ থেকে ২৫০ বছর আগেও একই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বিভাজিত জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত করেছে রাষ্ট্র জনগণের, কোনো রাজার নয়। বাংলাদেশ নামক দেশের জন্ম শুধু সেই ঐক্যের ফসল। এ দেশের ছাত্র-জনতা যখনই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রাজপথে দাঁড়িয়েছে, তখনই দেশীয় বা আগ্রাসনবাদীরা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে বা পালিয়েছে। নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে এ দেশের ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক-শ্রমিক-পেশাজীবী-মেহনতি মানুষ তাদের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে প্রমাণ করেছে যে, রাজপথ কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। চব্বিশে তেমনি ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিক দল-পেশাজীবীদের সম্মিলিত মৃত্যু কাফেলায় নির্মম, পাষণ্ড, নরপিশাচ, ডেভিল রানি হাসিনা শুধু পদত্যাগ করেই ক্ষান্ত হননি বরং প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কেন শেখ হাসিনাকে পালাতে হলো? রাষ্ট্রক্ষমতা পালাবদলের পরীক্ষিত ফ্রন্টলাইনার হলো উর্দিপরা আর্মি, বিদ্যমান শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী-আমলা ও বিদেশি হস্তক্ষেপ। শেখ হাসিনার দমনপীড়ন ছিল সর্বাত্মক। রাজপথের একমাত্র পরীক্ষিত বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে রেকর্ডসংখ্যক দেড় লাখ মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের স্বাভাবিক রাজনীতি করার অধিকারহীন করে তোলে। একটানা সাড়ে পনের বছর জাতি ও পুরো বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখেছে! আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম, অমানবিক ও বর্বর হামলা, গায়েবি মামলা, জেল-জুলুম-নির্যাতন, গুম-খুন-ক্রসফায়ার, চাকরি-ব্যবসা-পরিবারহীন একটা নরকীয় যুগ। অন্যদিকে জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের কারণে ফাঁসি দিয়ে দলটাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দেয়। ২০১৩ সালের পর থেকে লাখ লাখ শিবিরের নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি জমায়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে যেভাবে পেরেছে, হয় ছাত্রলীগের পেটে ঢুকে গেছে বা শহীদ আবরারের মতো জীবন দিতে হয়েছে। এককভাবে বিএনপি ফ্যাসিস্ট হাসিনাবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে প্রায় পাঁচ হাজারের ওপর নেতাকর্মী হারিয়েছে। তবুও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে এবং আহ্বানে দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে সব স্তরের নেতাকর্মী সেই আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের অবসানে ঐক্যবদ্ধ ছিল।
দেশে হাসিনা পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক অলিগার্ক তৈরি হয়েছিল, যারা আমৃত্যু তার সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের আগপর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশই সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে ভারতের লেন্স দিয়ে ট্রিটমেন্ট করতে চেয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে সাধারণ নাগরিক সে পুরুষ বা গৃহিণী যেই হোক, মন খুলে কথা বলতে বা লিখতে পারত না। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক যা সারাক্ষণ ডিজিএফআই বা এনএসআইয়ের নজরদারিতে থাকত। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮ বা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০২৩-এর আওতায় ২০১৮-২০২৩ পর্যন্ত ৭ হাজার ১টি মামলা করা হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৭ হাজার ১ মামলার মধ্যে ৯০৮ মামলা ছিল ফেসবুক পোস্টে শেখ হাসিনার সমালোচনা করার জন্য। ওইসব মামলায় ১৫ বছরের কিশোর বা দুধের বাচ্চার মায়েদেরও দিনের পর দিন জেল খাটতে হয়েছে। হাসিনার লোকাল প্রশাসন এসব দমনে ছিল কঠোর ও সিদ্ধহস্ত। ফ্যাসিস্ট হাসিনা মাঠের পরীক্ষিত দুই দলকে রাজনীতিশূন্য করে, সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধ করে, পারিবারিক ব্যবসায়িক অলিগার্ক তৈরি করে, গড়ে ওঠা স্বাধীন ইলেকটোরাল সিস্টেমকে ধ্বংস করে, প্রশাসন-আইন-বিচারাঙ্গন হাতের কবজা করে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বন্দোবস্ত করে। বিষয়টি এমন দাঁড়ায়, তাদের সামনে দাঁড়ানোর আর কোনো তৃতীয় শক্তিও নেই। রাজনৈতিক আন্দোলন দমন ও ডাইভারশনে ওস্তাদ হয়ে ওঠেন হাসিনা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সামাজিক অনাচার বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ জনগণ মাঝেমধ্যে সরব হলেও, সরকারের দমননীতির সামনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারত না। তবে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল তুষের আগুনের মতো। এভাবে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাধারণ নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী সবাইকে প্রতিপক্ষ বানালেও আনটাচ ছিল শুধু ছাত্ররা। সেই সংগ্রামী ছাত্রসমাজ প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নজরে আসে। এরপর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ ব্যানারে রাজপথে নামে এবং সেই দাবি হয়ে পড়ে আপামর জনগণের। তখনই স্বৈরাচার হাসিনা তার হেলমেট বাহিনী ও পুলিশ লীগ দিয়ে ডান্ডা মেরে আন্দোলন স্তিমিত করে। সাহস বেড়ে গিয়ে অবৈধ প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে ঘোষণা দেন—‘এখন আর কোটা থাকবে না, এটা বাতিল করা হবে’। এ বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামে, যা চলেছিল মোটামুটি পাঁচ মাস। এরপর হরেদরে হামলা করে, পিটিয়ে ক্যাম্পাস হতে তাড়িয়ে, টাকাপয়সা দিয়ে, গোয়েন্দা লাগিয়ে, পোষা সাংবাদিকদের ভুয়া রিপোর্ট প্রচার করে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো অ্যান্টিবডি নেয়। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসেন। ক্ষমতার হানিমুন পিরিয়ডের মধ্যেই ৫ জুন হাসিনার ক্যাঙ্গারু সুপ্রিম কোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনঃসংযোজনের আদেশ জারি করেন। এর প্রতিবাদে সচেতন ছাত্রসমাজ আর চাকরিপ্রত্যাশীরা ফুঁসে উঠল। সরকার সেই পুরোনো কায়দায় আন্দোলন দমনে প্রথমে ভাড়াটে হেলমেট বাহিনী, ছাত্রলীগ, পরে যুবলীগ এবং সবশেষ আওয়ামী লীগকে মাঠে নামায়। জাতি দেখল তাদের প্রিয় সন্তানদের সরকারের পেটুয়া বাহিনী রাস্তায় ফেলে পেটাচ্ছে ও হল থেকে বের করে দিচ্ছে। এ মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নেমে এলো এবং আন্দোলনকারীদের সুরক্ষায় ঢাল হিসেবে দাঁড়াল। আন্দোলনে একে একে সম্পৃক্ত হতে থাকল টেম্পো-রিকশা-ভ্যানচালক, দিনমজুর, পোশাকশ্রমিক, শ্রমজীবী মানুষ, ডাক্তার, শিক্ষক, পেশাজীবী, বিএনপির সব স্তরের নেতাকর্মী, জামায়াতের নেতাকর্মী ও অন্যান্য গণতন্ত্রপ্রেমী রাজনৈতিক সংগঠন। বিশেষ করে বাবা-মা-গৃহিণী ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীর উপস্থিতি দিন দিন বাড়তে থাকল। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি মোতায়েন করল। গণসম্পৃক্ততা বেড়ে যাওয়ার একপর্যায়ে এটি প্রচণ্ড গণবিদ্রোহে রূপ নেয়। পরের ইতিহাস সবার জানা।
ঊনসত্তরের ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ আর চব্বিশের ‘চাকরি কি তাহলে রাজাকারের বাচ্চারা বা নাতিপুতিরা পাবে?’—এ জিজ্ঞাসা থেকেই বাংলাদেশপন্থি সব স্টেকহোল্ডার একত্রিত হয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে এবং হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত ও পলায়নে বাধ্য করে।
লেখক: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
মন্তব্য করুন