চলতি সপ্তাহে পালিত হচ্ছে আবালবৃদ্ধবনিতা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মম সহিংসতা, ধর্ষণ ও গণহত্যার ষষ্ঠবার্ষিকী। শাসক বাহিনীর এ নিষ্ঠুর ও গণহত্যার কারণে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুর তিন-চতুর্থাংশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে আসার সময় তারা বসতভিটা থেকে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নিয়েও আসতে পারেনি। যে কারণে তারা বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। যদিও এই ছয় বছর পর রোহিঙ্গাদের অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নয়ন ঘটেছে, তাদের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। এর কারণ তাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তা সত্ত্বেও কিছুটা আশা রয়েছে কারণ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ গণহত্যা এড়িয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে জীবনের নিরাপত্তা পেয়েছে। আমিসহ মিয়ানমারের অন্যান্য পর্যবেক্ষকের কাছে এ ধরনের উন্নয়নগুলোর কোনোটিই আসলে বিস্ময়কর ছিল না। কারণ আমরা জানতাম এরকমটাই ঘটবে বা ঘটতে পারে। আমরা অনেকেই এ ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির বেসামরিক সরকারের সহযোগিতায় গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে।
তবে ঘটনা বা বাস্তবতা যাইহোক, যা প্রত্যাশিত ছিল না তা হলো যে, গণহত্যার পর সামরিক বাহিনী কর্তৃক নির্বাচিত বেসামরিক প্রশাসনকে উৎখাত এবং সেসব নাগরিকের বিরুদ্ধে সেই একই নৃশংস কৌশল প্রয়োগ যারা কি না, আগে তাদের (সামরিক বাহিনীকে) সমর্থন করেছিল। নিঃসন্দেহে এর অন্তর্নিহিত ব্যাপারটি ছিল এরকম যে, আপনি যদি গণহত্যার (বা কোনো অন্যায়ের) প্রতিবাদ না করেন, তাহলে এর পরের শিকার আপনিই হবেন। এটা সাধারণ একটা সমীকরণ। মিয়ানমারের বেসামরিক ব্যক্তিরা এটা বিশ্বাস করেছিল যে, দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে উৎখাত করেই সন্তুষ্ট হবে। তাই তারা কখনোই অনুমান করেনি যে, তারা যে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করেছিল, সেই একই সামরিক বাহিনী খুব শিগগির তাদেরও আক্রমণ করে বসবে। সর্বোপরি, রোহিঙ্গারা জাতিগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন ছিল। তাই তারা ছিল মিয়ানমারের বৌদ্ধ কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু। এতদসত্ত্বেও ব্যাপকভাবে প্রচারিত একটি ট্র্যাজেডি রয়েছে, যা মিয়ানমার সম্পর্কে একটি নির্মম বাস্তবতা লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। ব্যাপারটি হচ্ছে এই দেশটি পৃথিবী-নামক গ্রহের সবচেয়ে দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে জটিল নাগরিক সংঘাতের মধ্যে নিমজ্জিত। আর এ বিবাদের প্রতিটি দিকই জাতিগত বা ধর্মীয় বিভাজন দ্বারা চিহ্নিত। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, উভয় কারণেই এ সংঘাত তৈরি হয়।
রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা সংখ্যালঘু উপদলের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের চলমান সামরিক অভিযানের সামান্য একটি উদাহরণ মাত্র। সেনাবাহিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে একবার রোহিঙ্গা ইস্যুটি স্পষ্টতই ‘মীমাংসা’ হয়ে গেলে, দেশটি তার অন্যান্য সম্পদকে অন্য কোনো ফ্রন্টে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনারত ছিল। সেই সময়ে, মিয়ানমারের অবশিষ্ট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোকে অনুরূপ আচরণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। কারণ এ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে কিছু অংশ প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময়ব্যাপী সামরিক দমনপীড়নের লক্ষ্যবস্তু ছিল। কিন্তু এ সময়ের নিপীড়নগুলো আগের সব কষ্টকে ছাড়িয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান নাটকীয়ভাবে জাতিগত নির্মূলের জন্য সামরিক বাহিনীর সক্ষমতাকে প্রসারিত করেছে। এ ছাড়া আরও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের জাতিগত নির্মূলতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে কারণ সে দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ আগ্রাসনকে সমর্থন করেছিল। এ দ্বন্দ্বগুলোর স্থায়ী প্রকৃতি এবং তাদের সাম্প্রতিক সম্প্রসারণ উপলব্ধি করার জন্য কাউকে অবশ্যই মিয়ানমারের জনসংখ্যাগত এবং রাজনৈতিক গতিশীলতা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ হচ্ছে বামার (জাতিগতভাবে বার্মিজ), যা মূলত ইরাবতী উপত্যকার আশপাশের এলাকায় কেন্দ্রীভূত। আর এ কেন্দ্রই হচ্ছে দেশের মূল। মিয়ানমার নামক দেশটি প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এখানে ৮৮ শতাংশ মানুষ রক্ষণশীল থেরাবাদ মতবাদ মেনে চলে। ইরাবতী উপত্যকার সীমানা ঘেঁষে বেশ কয়েকটি অঞ্চল রয়েছে। সেসব অঞ্চলে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ রয়েছে যার প্রায় সবাই মিয়ানমার, তৎকালীন বার্মা, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নিজেদের স্বাধীনতা চেয়েছে।
এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলো আবির্ভূত হয়েছিল কারণ স্বাধীনতার পরপরই বার্মার থেরাবাদ বৌদ্ধরা সরকার ও সামরিক বাহিনীর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য স্তরের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে। এ ছাড়া সরকারি রাষ্ট্রীয় পরিচয় হিসেবে তাদের ওপর পরিচয় আরোপ করা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে সামরিক শাসনের একটি সিরিজ বিভিন্ন নিপীড়নমূলক কৌশলের মাধ্যমে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পরিকল্পিতভাবে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠী বানিয়ে ফেলে এবং দমনপীড়ন শুরু করে। এ ছাড়া মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তাদের গ্রামগুলো ধ্বংস করা হয়েছিল এবং একই সঙ্গে তাদের বিবাহের অধিকার খর্ব করা হয়েছিল। দেশটির রাখাইন রাজ্যে, রাজ্য কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের সন্তানের সংখ্যার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। তারা মুসলমানদের সন্তান সংখ্যা দুটিতে সীমাবদ্ধ করে দেয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা ছিল জনসংখ্যা প্রতিস্থাপনের হারের ঠিক নিচে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মধ্যে সংঘর্ষ পুনরায় দেখা দিয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী তার পুরোনো সংকল্পকে আবার পুনরুজ্জীবিত করেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেনস আর্মির মধ্যে ২০১১ সালের যুদ্ধে দেশের উত্তরে প্রায় এক লাখ কাচিন অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। বহু বছর পরে এ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিরা তাদের জীবন পুনর্গঠনের খুব কম সম্ভাবনা নিয়ে অভ্যন্তরীণ শরণার্থী শিবিরে বসবাস করতে থাকে। গত দুই বছরে, সামরিক বাহিনী বেসামরিক ক্যাম্প এবং গ্রামের কাছাকাছি বা তার কাছাকাছি লক্ষ্যবস্তুতে গোলাবর্ষণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে, সামরিক বাহিনী এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির মধ্যে শত্রুতা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। মনে করা হচ্ছে যে, এটি সেই পুরোনো সংঘাতের সম্প্রসারণ, যা ১৯৬৩ সালের দিকে শুরু হয়েছিল। তখন হাজার হাজার শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে চীনে পৌঁছায়। আবার দেশটির দক্ষিণে সেনাবাহিনী কারেন জনগণের মধ্যে থেকে খ্রিষ্টানদের তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পরিণত করেছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এক লাখেরও বেশি শরণার্থীকে থাইল্যান্ডে যেতে বাধ্য করেছে।
তবে জনগণের এ বাস্তুচ্যুতি শুধু রোহিঙ্গাদের দুর্দশার প্রতিফলন নয়। কাচিন ও কারেন নারীদের নানাভাবে নিপীড়ন করা হয়েছে। এমনকি এসব নারীদের সামরিক বাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে নানা সময়ে। আর এসব ঘটনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্বারা পূর্বে বর্ণিত গণধর্ষণেরই এক প্রতিধ্বনি।
সম্ভবত মিয়ানমারের সাম্প্রতিক অস্থিরতার সবচেয়ে বাজে এবং দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে যে, ঠিক এ সময়েই দেশটি গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ২০১৫ সালে যখন অং সান সু চির নেতৃত্বে একটি বেসামরিক সরকার নির্বাচিত হয়েছিল, তখন পশ্চিমা বিশ্বের আশা ছিল যে তিনি সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়িকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। সহিংসতার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। এ ঘটনার মূল কারণ জাতিগত বিদ্বেষ নিয়ে গত কয়েক দশকের সরকারি প্রচারণা। এর ফলে মিয়ানমারের ভোটারদের মধ্যে অ-বৌদ্ধ এবং
অ-বার্মার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এক গভীর পক্ষপাতিত্বের জন্ম দিয়েছে।
মিয়ানমারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে উগ্রবাদী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং কথিত বিশুদ্ধ বৌদ্ধ রাষ্ট্রের দূতদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। রোহিঙ্গা বা খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে ওকালতিকারী সুশীল সমাজের দলগুলো এ ধরনের পরিবেশে কার্যত অস্তিত্বহীন। এ উপলব্ধির কারণেই বিরোধী দলের মন্ত্রী উইন মায়াট আয়ে অবশেষে ‘উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে’ কর্তৃপক্ষের অক্ষমতার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মূলত এ অঞ্চলেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে নৃশংসতা শুরু করেছিল।
উইনের এ ক্ষমা চাওয়া থেকে এটা স্পষ্ট যে, তিনি তার আগের মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কারণ ২০১৭ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এটা স্পষ্ট হয়েছিল, সে সময় তিনি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একটি অপরিহার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামরিক পদক্ষেপকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি সামরিক পদক্ষেপের পক্ষে ছিলেন। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, রোহিঙ্গারাই কি নিজেদের গ্রামে আগুন লাগিয়েছে কি না, তিনি তখন উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেন। ছয় বছর পর তার আগের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিদ্রোহীদের নির্মূল করার জন্য ২০১৭ সালের অভিযানের ইঙ্গিত দিয়ে উইন বলেন, ‘বেসামরিক সরকার হিসেবে আমরা সেই সময় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অক্ষম ছিলাম। এসব নিয়ে চিন্তা করলে আমার ভেতরে এক গভীর অনুশোচনার তৈরি হয়। এ গুরুতর ত্রুটির জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। কেন আমরা সেই সময়ে ন্যায়বিচার দিতে পারিনি তা এখন স্পষ্ট।’
লেখক : ওয়াশিংটন ডিসিতে নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির একটি বিশেষ উদ্যোগের পরিচালক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন আমরিন খান
মন্তব্য করুন