মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ পরিবেশের অংশ। বসবাসের জন্য এবং নিজস্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুটনের জন্য এদের মধ্যে কোনোটির প্রয়োজন হয় সমতল ভূমি বা পাহাড়, কোনোটির জলাধার আবার কোনোটির বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। সেইসঙ্গে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নির্মল বাতাস, আলো, পানি ও মাটির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই পরিবেশ যখন বিভিন্ন কারণে দূষণযুক্ত হয়ে পড়ে, তখন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে ওঠে।
শিল্প-বিপ্লব ও জীবনযাত্রার আধুনিকায়ন, সেইসঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, জীবাশ্ম-জ্বালানি, প্লাস্টিক ও ভারী ধাতুর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, মারণাস্ত্র ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার, শব্দ ও আলো দূষণ ইত্যাদি প্রতিনিয়তই সুন্দর এ বিশ্বের পরিবেশকে বিপন্ন ও দুর্বিষহ করে তুলছে। ইদানীং পরিবেশ দূষণের মাত্রা এতটাই মারাত্মক ও ভয়াবহ হয়ে উঠছে যে, অনেক প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে না পেরে এরই মধ্যে বিরল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
আমরা জানি পরিবেশের এ ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী একমাত্র মানুষ। আর মনুষ্যবিহীন প্রকৃতি যে কতটাই নিরাপদ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে ইউক্রেনের অদূরে অবস্থিত চেরনোবিল নামক স্থানটিতে; যেখানে ঘটে গিয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ১৩০ কিলোমিটার উত্তরে এবং বেলারুশের সীমান্ত থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনাটি ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে চারটি চুল্লির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২ এপ্রিল অসাবধানতাবশত স্থাপনাটির একটি চুল্লিতে আগুন ধরে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। চুল্লিগুলোতে নকশায় এবং গঠনগত অনেক ত্রুটি থাকায় দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। চুল্লির বিভিন্ন অংশের ভাঙা জঞ্জাল বৃষ্টির মতো চতুর্দিকে এবং তেজস্ক্রিয় জ্বালানি থেকে বিকিরণের মেঘ দ্রুত পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে, চুল্লি থেকে আগুন পার্শ্ববর্তী স্থাপনাগুলোতে বিস্তৃতি লাভ করে। তাৎক্ষণিকভাবে দুজনসহ দুর্ঘটনার এক মাসের মধ্যে ৩১ জন এবং পরবর্তী সময়ে আরও প্রায় চার হাজার মানুষ তেজস্ক্রিয় দূষণযুক্ত বিভিন্ন জটিলতায় মারা যায়। উন্মুক্ত স্থান, জলাশয়, সবুজ মাঠ, বনাঞ্চল এবং কৃষিক্ষেত্রগুলো উচ্চমাত্রায় দূষণযুক্ত হয়ে পড়ে। প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর কৃষিজমি এবং ৪ লাখ ৯২ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল দীর্ঘদিনের জন্য স্বাভাবিক ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা থেকে প্রায় এক লাখ লোক বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয় এবং দুটি শহরসহ বহু গ্রাম মানবশূন্য হয়ে পড়ে। পারমাণবিক এ মহাদুর্যোগের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা স্থানের চারপাশে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে বিধ্বস্ত হিসেবে গণ্য করে এবং মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী বিবেচনায় ‘বর্জনীয় স্থান’ বলে ঘোষণা করে।
মানুষ ছাড়াও দুর্ঘটনাসংলগ্ন স্থান এবং এর চারপাশ এলাকার বহু বন্য ও গৃহপালিত পশুপাখি তেজস্ক্রিয়তার তাৎক্ষণিক প্রভাবে মারা যায়। বেঁচে যাওয়া দূষণযুক্ত অনেক গৃহপালিত পশুকে মেরে ফেলা হয় বা দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। চেরনোবিলের নিকটবর্তী বনাঞ্চলে অন্তত প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত বন্যপ্রাণীর স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি ঘটতে দেখা যায়। পানি দূষণযুক্ত হয়ে পড়ায় জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিস্তীর্ণ এলাকার উদ্ভিদ ও গাছপালা সরাসরি দূষণযুক্ত হয়ে পড়ে। উদ্ভিদ যে স্থানে বেড়ে ওঠে, সে স্থানের পানি ও মাটিতে মিশ্রিত তেজস্ক্রিয়তা খাদ্যচক্র দ্বারা উদ্ভিদের দেহে প্রবেশ করে, এমনকি ফলমূলের মধ্যেও বিস্তৃতি লাভ করে এবং তা মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে এভাবেও অনেক উদ্ভিদ, গাছপালা ও পশুপাখি তেজস্ক্রিয় দূষণযুক্ত হয়ে পড়ে। পাইনগাছ অধ্যুষিত চেরনোবিলের পাইন বাগানসহ অন্যান্য গাছপালার বেশিরভাগই পুড়ে গিয়ে লালচে রং ধারণ করে আর তাই এলাকাটি ‘রেড ফরেস্ট’ নামে পরিচিতি পায়। পুড়ে যাওয়া গাছসহ দূষণযুক্ত সব গাছ কেটে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
বিকিরণ জিনগত পরিবর্তন (মিউটেশন) দ্বারা বংশগতির ধারা এবং বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিকৃত বা পরিবর্তিত করে তোলার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। চেরনোবিল দুর্ঘটনার পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত পশুদের মধ্যে জন্মগত ত্রুটিযুক্ত বংশধর প্রসব করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। কোনো কোনোটির মধ্যে জন্মগত ত্রুটি এতটাই প্রকট ছিল যে, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বা জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। পরবর্তী সময়ে বেঁচে যাওয়া জন্মগত ত্রুটিযুক্ত প্রাণীগুলোর প্রজনন ক্ষমতাও হ্রাস বা লোপ পেতে দেখা গেছে। ওই এলাকায় এখনো কোনো কোনো পশুপাখি জিনগত মিউটেশন নিয়ে জন্মায়।
পারমাণবিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয় বস্তুর বড় একটা অংশই আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ও প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে খুব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।
‘বর্জনীয় স্থান’ ঘোষণা করা হলেও বিজ্ঞানীরা দুর্ঘটনাকবলিত এলাকাটি সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে রেখে পরিবেশ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদের ওপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে থাকেন।
চেরনোবিলে যদিও খুবই উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার নির্গমন ঘটেছিল কিন্তু পরবর্তীকালে আক্রান্ত স্থানগুলোর মাটি, পানি ও বাতাসে রেডিয়েশনের মাত্রা দ্রুততার সঙ্গে হ্রাস পেতে থাকে। মাসখানেকের মধ্যেই প্রাথমিক দূষণের খুব কম শতাংশই পরিবেশে বিদ্যমান থাকে এবং এক বছরের মাথায় তা ১ শতাংশেরও নিচে নেমে আসে। তবে বেশি অর্ধায়ুবিশিষ্ট তেজস্ক্রিয় বস্তুর ক্ষতিকর প্রভাব পরিবেশে সুদীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকবে।
কোনো বিপর্যয়ের পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার অদ্ভুত একটি ক্ষমতা আছে প্রকৃতির। আর মনুষ্য বসতি এবং জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড হ্রাস করতে পারলে প্রকৃতি আপন ক্ষমতা ও মহিমাতেই উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে। দুর্ঘটনার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর চেরনোবিলের প্রকৃতিও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে থাকে এবং কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় ভূতুড়ে ও কোলাহলহীন এলাকাটি প্রাকৃতিকভাবেই ঘন জঙ্গলে ঢেকে যায়। কম আক্রান্ত এলাকা থেকে প্রাণীগুলো কোলাহলহীন এই এলাকায় ফিরতে থাকে, নতুন প্রজন্মের আগমন ঘটে এবং ছোট-বড় মেরুদণ্ডী প্রাণী, বিভিন্ন প্রকার উভচর প্রাণী, বহু প্রজাতির মাছ, পাখি ছাড়াও অসংখ্য ধরনের পোকামাকড়ের নির্ভয় আবাসস্থলে পরিণত হয় এবং এলাকাটি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর হয়ে ওঠে।
রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা ইউক্রেনের এই এলাকার ওপর বিস্তৃত গবেষণা চালান। দেখা যায়, ‘বর্জিত এলাকা’য় ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে শূকর, ছোট হরিণ, লম্বা শিংবিশিষ্ট বড় হরিণের সংখ্যার যেন বিস্ফোরণ ঘটেছে। নেকড়ের পরিমাণ সাতগুণ বৃদ্ধি পায়, ইউরেশিয়ান বনবিড়াল, নেকড়ে, বাদামি ভালুক, কালো রঙের সারস পাখি, ইউরোপিয়ান বন্য ষাঁড়সহ গবেষকরা বিরল প্রজাতির বিভিন্ন গাছপালা ও প্রাণীর অস্তিত্বও দেখতে পান। কয়েক বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় সমান পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৪০০ প্রাণীর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, এদের বৃদ্ধি স্বাভাবিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলো বেশ স্বাস্থ্যবান, বংশবৃদ্ধিও স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে এবং এগুলো যে মোটামুটি দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে আছে, সেই প্রমাণও পাওয়া গেছে। এ থেকে বিজ্ঞানীদের ধারণা হয়, কোনো কোনো বন্যপ্রাণীর তেজস্ক্রিয়তা সহ্য করার ক্ষমতা অথবা অভিযোজন ক্ষমতা বেশি, যার কারণে দেহের গঠনগত ও কার্যগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তাযুক্ত প্রতিকূল পরিবেশেও জীবন টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে।
‘বর্জনীয় স্থান’ ঘোষিত চেরনোবিলের বনাঞ্চলটি বর্তমানে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক সংরক্ষিত এলাকা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ বনাঞ্চল ও পত্রপল্লবের সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণীর প্রাচুর্যতা ও জীববৈচিত্র্যের কারণে বর্তমানে পর্যটকদের কাছে স্থানটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ পর্যটক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পারমাণবিক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাটি পরিদর্শনে আসছে। ইউক্রেনের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব লাইফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের বনায়ন বিশেষজ্ঞ সার্গেই জিবতস্সেভ ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘একটি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পরিবেশ গড়ে তুলতে এমন একটি ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক দুর্ঘটনার প্রয়োজন হলো!’
কিন্তু দুঃখের বিষয়, অতি সাম্প্রতিককালে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ এই প্রাকৃতিক সম্পদকে আবার হুমকির সম্মুখীন করে তুলছে এবং গবেষণার সুযোগগুলোকেও সংকুচিত করে ফেলছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, মানুষ যদি এ বিশ্বে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে টিকে থাকতে চায়, তাহলে তাদের অবশ্যই যুদ্ধবিগ্রহ পরিত্যাগ করতে হবে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকল্পে জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বনাঞ্চল সংরক্ষণ, ভূমিদূষণ ও ক্ষয়রোধ, পানিদূষণ রোধ ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: পরমাণু বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সাভার
মন্তব্য করুন