ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তারল্য বেড়েছে, রিজার্ভ বেড়েছে, ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়েছে—সব মিলিয়ে এটি ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক সংকেত।
দুর্নীতি ছাড়া হাসিনার সরকারের কোনো নীতি ছিল না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনামলের ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। সেই হিসাবে হাসিনার সরকার ১৫ বছরে পাচার করেছে ২৪০ বিলিয়ন বা ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আমাদের গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বয়ানের আড়ালে লুণ্ঠন করেছেন, তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। দুঃখের বিষয় হলো, তারা প্রকাশ্যে এ লুটপাট চালিয়েছেন। আমাদের বেশিরভাগ অংশই এর মোকাবিলা করার সাহস করতে পারেনি।
বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ছোট-বড় মিলিয়ে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এসব প্রকল্প নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে বড় ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এতে কমিটি দেখেছে, বড় প্রকল্পের প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং জমি কেনায় হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে বাড়ানো হয়েছে অনেক, যা টাকার অঙ্কে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। কমিটি জানিয়েছে, কোথাও কোথাও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপিতে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছেন। পতিত স্বৈরাচারী শাসনামলে ভয়ের রাজত্ব এতটাই ছিল যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণকারী বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোও এ লুণ্ঠনের ঘটনায় অনেকাংশে নীরব ছিল। দেশের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান তারা ধ্বংস করে দিয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও লুটপাটের খবর বেরিয়ে আসতে থাকায় অস্থিরতায় ভুগছে দেশের ব্যাংক খাত। তবে আশার কথা এই যে, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বাড়তে শুরু করেছে আমানতের পরিমাণ। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংক খাতে আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। আর জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
আমরা মনে করি, সরকার পরিবর্তনের পর বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিনিয়োগে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। উচ্চ সুদের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য বেড়ে গেছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে দেশের আর্থিক খাতে স্বস্তি ফেরার লক্ষণ, যা আমাদের সবার জন্য একটি সুসংবাদ।
মন্তব্য করুন