‘গুজব’ এতটাই প্রচলিত শব্দ যে, এর মর্মার্থ কাউকে বলে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। প্রচলিত ধারণা হলো, প্রমাণহীন, অসমর্থিত ও মনগড়া তথ্যের প্রচারই হলো গুজব। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্রচারমাধ্যমের দরকার পড়ে না। মানুষের মুখে মুখে বিদ্যুৎবেগে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এ সময়ে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহারে এর প্রসারতার গতি বেড়েছে শতগুণ। এর রয়েছে ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা; যা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে গজব বয়ে আনতে পারে। সৃষ্টি করতে পারে বিশৃঙ্খলা-হানাহানি; লন্ডভন্ড করে দিতে পারে একটি দেশকে।
ভিত্তিহীন হলেও গুজবের সংজ্ঞা আছে। ইংরেজি ‘রিউমার’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘গুজব’। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, গুজব হলো কোনো অযাচাইকৃত তথ্য, যা মানুষের মধ্যে প্রচারিত হয় কোনো দৃঢ় প্রমাণ ছাড়াই। সমাজবিজ্ঞানে গুজব বলতে এমন এক ধরনের বিবৃতিকে বোঝায়, যার সত্যতা দ্রুত বা কখনোই নিশ্চিত করা যায় না। কোথাও আবার গুজবকে ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক, সোজা বাংলায় গুজব হলো শিকড়বিহীন উদ্ভিদের মতো, যার উৎপত্তির হদিস পাওয়া যায় না। সব সংজ্ঞাতেই গুজবকে ‘মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত বিবৃতি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা এমন এক ধরনের প্রচারণা, যার জন্ম হয়ে থাকে ধারণাগত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। কখনো প্রচারকের ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়গত স্বার্থকে লক্ষ্য রেখে এর উৎপত্তি হয় এবং প্রচারণা চলে। আবার অনেক সময় সমাজ বা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খল পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে ফায়দা লোটার উদ্দেশ্যে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা করতে পারে দেশীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী কিংবা বিদেশি শক্তির মদদপুষ্ট স্বার্থান্বেষী মহল। গুজবের উৎস কখনোই খুঁজে পাওয়া যায় না। জিজ্ঞেস করলে শোনা যায় একই উত্তর—‘সবাই বলছে।’ কিন্তু এই ‘সবাই’ কে বা কারা, তা কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না।
গুজবকে নিছক ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিলেও এটা কিন্তু মোটেও ফালতু বিষয় নয়। এরও গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, গুজব অনেক সময় একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে ভয়ংকর বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে; যা দেশ ও জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেজন্যই সরকারি প্রচারণায় জনসাধারণকে পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে ‘গুজবে কান দেবেন না’। কিন্তু নিরেট সত্যি হলো, গুজবে কান না দেওয়ার শত পরামর্শ সত্ত্বেও মানুষ গুজব শোনার জন্য তার কর্ণযুগলকে উৎকীর্ণ করে রাখে। আর তা শোনামাত্রই আরেকজনের কাছে ‘রিলে’ করে। এর ফলে একটি ভিত্তিহীন তথ্য সহজেই বিস্তার লাভ করে; বর্তমানে যেটাকে বলা হয় ‘ভাইরাল’ হওয়া। গুজব বিষয়টি সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। মনোবিজ্ঞান বলে, মনের সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবে দেখতে পাওয়ার আশায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গুজব আকারে তা সমাজে ছড়িয়ে থাকে। এ দুই বিষয়ের পণ্ডিত ব্যক্তিদের কেউ কেউ গুজবকে প্রচারণার একটি ‘উপসেট’, অর্থাৎ সহযোগী প্রচারণা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
গুজব যে শুধু বর্তমান সমাজের সমস্যা তা নয়, বহু পূর্বকাল থেকেই এটা চলে আসছে। ফলে গুজবের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। তা না হলে জার্মান-আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক লুই উইলিয়াম স্টার্ন (জন্ম ২৯ এপ্রিল, ১৮৭১; মৃত্যু ২৭ মার্চ, ১৯৩৮) গুজব নিয়ে গবেষণায় প্রবৃত্ত হতেন না। তিনি যে গবেষণা করেছিলেন, তার মধ্যে ‘বিষয়বস্তুর শৃঙ্খল’ জড়িত ছিল। গবেষণায় তিনি দেখতে পান যে, শৃঙ্খলের (শিকল বা চেইন) শেষপ্রান্তে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে গল্পটি সংক্ষিপ্ত এবং পরিবর্তিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ গুজবের প্রকৃতি হলো, এটি উৎপন্ন হওয়ার সময় যে অবয়ব থাকে, লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে তার বিষয়বস্তুর অনেকটাই বদলে যায়। গুজব নিয়ে গবেষণা করেছেন জার্মান মনোবিজ্ঞানী রবার্ট এইচ ন্যাপ। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ‘অ্যা সাইকোলজি অব রিউমার’। সেখানে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোস্টন হেরাল্ডের ‘রিউমার ক্লিনিক’ কলামে এক হাজারেরও বেশি গুজবের বিশ্লেষণ করে এর সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। তার সংজ্ঞা অনুযায়ী গুজব হচ্ছে, ‘আনুষ্ঠানিক যাচাই ছাড়াই প্রচারিত প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্রের বিশ্বাসের একটি প্রস্তাব।’ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, গুজব হলো অনানুষ্ঠানিক সামাজিক যোগাযোগের একটি বিশেষ উদাহরণ, যার মধ্যে রয়েছে মিথ, কিংবদন্তি এবং বর্তমান হাস্যরস। মিথ ও কিংবদন্তি থেকে এটি প্রাসঙ্গিকতার দিক দিয়ে আলাদা। যেখানে হাস্যরস হাসির উদ্রেক করার জন্য তৈরি করা হয়, বিশ্বাসের জন্য প্রার্থনা করে। রবার্ট এইচ ন্যাপ গুজবের ক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন—‘১. এগুলো মুখের কথার মাধ্যমেই ছাড়ায়; ২. তারা ‘ব্যক্তি ঘটনা বা অবস্থা’ সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে; ৩. তারা সম্প্রদায়ের মানসিক চাহিদা প্রকাশ করে এবং সন্তুষ্ট করে।’ তার অর্থ, গুজব হলো সেসব অপ্রমাণিত তথ্য, যেগুলো বিশেষ কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর স্বার্থে লোকমুখে ছড়ানো হয়। ন্যাপ তার গবেষণায় আরও দেখিয়েছেন, ইতিবাচক গুজবের চেয়ে নেতিবাচক গুজব ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত ও বেশি।
অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে পরিচালিত গবেষণায় মনোবিজ্ঞানী গর্ডন অলপোর্ট ও লিও পোস্টম্যান তাদের গবেষণায় দেখতে পান, গুজব যত ছড়িয়ে পড়ে তা ততই ছোট, মানে সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, প্রথম ৫-৬টি মুখ থেকে প্রচারিত একটি বার্তার প্রায় ৭০ শতাংশ বিবরণ শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যায়। গর্ডন ও পোস্টম্যানের গবেষণার এ তথ্যটির সঙ্গে অবশ্য আমাদের দেশে প্রচারিত গুজবগুলোর মধ্যে কিছুটা অমিল রয়েছে। তারা বলেছেন, গুজব যতই প্রচারিত হয়, তার আকার ততই সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। আর আমাদের দেশের একটি ভিত্তিহীন তথ্য যখন গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন ক্রমেই তার আকার বাড়তে থাকে। যেমন ধরুন, কেউ একটি গুজব ছড়াল অমুক জায়গায় মারামারিতে তিনজন হতাহত হয়েছে। খবরটি শুনে সে বিবেচনা করে দেখল না, এ হতাহতদের মধ্যে কতজন নিহত, কতজন আহত হয়েছে। সে হয়তো প্রচার করল তিনজন নিহত, কয়েকজন আহত। শেষমেশ দেখা যায়, ‘অগণিত মানুষ মারা গেছে’ বলে খবর পৌঁছে যায় সবার কাছে। এটাকে বলা হয় গুজবের ডালপালা বিস্তার।
আমাদের দেশে গুজবের বিস্তৃতি সর্বব্যাপী। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে গুজবের প্রবেশাধিকার অবারিত এবং প্রভাবও উপেক্ষা করার মতো নয়। ধরুন, কেউ প্রচার করে দিল বাজারে অমুক পণ্যটির প্রচণ্ড অভাব। ব্যস, অচিরেই তা উধাও হয়ে যাবে বাজার থেকে। আর সবাই ‘কান নিয়েছে চিলে’র মতো কানে হাত না দিয়ে ছুটবে চিলের পিছু পিছু। অর্থাৎ সে পণ্যটি কিনে ঘরে মজুত করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় পণ্য সংকট। আর এ সুযোগ টু পাইস কামিয়ে নেয় সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা। এইতো বছর পাঁচেক আগের কথা। এক বিকেলে হঠাৎ দেখা গেল সবাই লবণের প্যাকেট হাতে ঘরে ফিরছে, কেউ ঘর্মাক্ত কলেবরে ছুটছে মহল্লার দোকানের দিকে লবণ কেনার জন্য। কারণ কী জানতে চাইলে তারা বলল, ‘খবর পাওয়া গেছে দেশে লবণ নেই, দাম বেড়ে যাবে। এ সুযোগে দোকানিরা তাদের দোকান থেকে লবণ সরিয়ে ফেলল। আর তার প্রতিক্রিয়ায় ওই বিকেলেই লবণের দাম তিনগুণ হয়ে গেল। এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির খবর টিভিতে প্রচারিত হওয়ার পর সরকার নড়েচড়ে বসে এবং পরদিনই লবণের দাম স্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন আগের দিন দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যে লবণ ক্রেতারা নিষ্ফল আফসোস করেছে। কিন্তু লবণ-সংকটের ওই গুজবের উৎপত্তি কিংবা প্রচারক কে বা কারা, তার হদিস পাওয়া যায়নি।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুজবের প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। এতে নিমিষেই দেশে সৃষ্টি হতে পারে ভয়াবহ সংকট। ঘটে যেতে পারে মারাত্মক প্রলয়কাণ্ড। এমনকি দেশের সার্বভৌমত্ব পড়তে পারে হুমকির সম্মুখীন। তেমনি একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল গত ৩১ আগস্ট রাতে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং দেশে ভয়ংকর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে গুজবটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোর অফিসে আসতে থাকে মুহুর্মুহু ফোনকল—‘কী হচ্ছে, কী হতে যাচ্ছে’ জানতে চেয়ে। গুজবটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে যে খুব বেশি সময় লাগেনি, তা বুঝতে পারি সুদূর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে অনুজপ্রতিম ভক্ত সাইফুলের ফোনে। সে জানতে চাইল, ‘দাদা, আসল খবরটা কী?’ বললাম, ‘গুজব, কান দিও না।’ সাইফুলের মতো অনেকেই ফোন করে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন পরিচিত গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। তাদের উদ্বেগের প্রধান কারণ ছিল, দেশ আবার না অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে!
অবশেষে জনমনে স্বস্তি নেমে আসে পরদিন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা ও পরে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর। বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলে আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ অধিদপ্তর (আইএসপিআর) এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ও। উভয় স্থল থেকে জানানো হয়, সেনাপ্রধান ওয়াকার প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, সরকারের সব কাজে সেনাবাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। তিনি প্রচারিত গুজবে কান না দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেন। এ ঘটনা থেকে আমরা গুজবের শক্তি সম্বন্ধে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। একটি গুজবের সংক্রমণ থেকে গোটা দেশবাসীকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর প্রধানকে মাঠে নামতে হয়েছে।
গুজব ছড়ানো অপরাধ এটা সবাই জানি। কিন্তু সে অপরাধে কেউ শাস্তি পেয়েছে, এমন নজির নেই। ফলত গুজব নামের ভাইরাসটি দ্রুত ছড়ায়। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, একমাত্র জনসচেতনতা সৃষ্টিই এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের প্রধান উপায়। সে সঙ্গে দু-চারজন গুজব রটনাকারীকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে এর প্রকোপ অনেকটাই কমে আসতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন