বিশ্ব যত এগোচ্ছে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তত গভীরভাবে প্রবেশ করছে। আমরা ঘুম থেকে ওঠার পর যে প্রথম বস্তুটির দিকে হাত বাড়াই, সেটি হলো মোবাইল ফোন। কাজের প্রয়োজনে, বিনোদনের কারণে কিংবা নিছক অভ্যাসবশত—প্রযুক্তি ছাড়া আমাদের একমুহূর্তও চলে না। শিশু থেকে শুরু করে প্রবীণ, সব বয়সী মানুষ আজ প্রযুক্তিনির্ভর। কিন্তু এ নির্ভরতা কতটা স্বাস্থ্যকর? বিশেষত, আমাদের কল্পনা শক্তি, যা মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ; তা কি প্রযুক্তির আক্রমণে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে?
একসময় শিশুদের শৈশব মানেই ছিল গল্প শোনা, বই পড়া, মাঠে খেলা আর নানারকম কল্পনার জগৎ তৈরি করা। তারা মাটির স্তম্ভকে বানাত কল্পনার পাহাড়, লাঠিকে বানাত তরবারি, মাটির দিয়ে বানাত খেলনা গাড়ি, আসবাবপত্র। প্রতিটি সাধারণ জিনিসের ভেতরেই তারা নতুন এক অর্থ খুঁজে নিত, যা কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করত, সৃজনশীলতা তৈরি করত। কিন্তু এখনকার শিশুদের হাতে যখন স্মার্টফোন, তখন তারা তৈরি খেলায় অংশ নিচ্ছে, তৈরি ভিডিও দেখছে, তৈরি গল্প শুনছে। ফলে তাদের কল্পনার ডানা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। প্রযুক্তি অবশ্যই শুধু নেতিবাচক নয়। এটি জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডার খুলে দিয়েছে। যে তথ্য একসময় লাইব্রেরির বই ঘেঁটে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ খুঁজতে হতো, তা আজ পাওয়া যায় কয়েক সেকেন্ডে। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও দেখে শিখছে, গবেষকরা বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার সুযোগ পাচ্ছেন, শিল্পীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন ধরনের সৃজনশীল কাজ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে। পাশাপাশি একটি বড় সত্য হলো, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের মস্তিষ্ককে অলস করে তুলছে। যখন সবকিছু আমাদের হাতে তৈরি অবস্থায় চলে আসে, তখন চিন্তা করার, কল্পনা করার, নতুন কিছু ভাবার তাগিদ কমে যায়।
আমরা যদি ব্যক্তিগত জীবনেও তাকাই, দেখি আগে অবসর মানেই ছিল বই পড়া, ডায়েরি লেখা, গল্প ভাবা কিংবা বন্ধুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা। এগুলো আমাদের সৃজনশীলতাকে জাগিয়ে রাখত, কারও সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার মাধ্যমে আমরা নানা কিছু জানতে পারতাম, নানারকম মনোভাব তৈরি হতো। এখন অবসর মানেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানো। সেখানে আমরা মূলত ভোক্তা—অন্যের তৈরি লেখা, ছবি, ভিডিও ভোগ করছি। ফলে আমাদের কল্পনাশক্তির ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন, আজকের শিশুরা দ্রুত তথ্য গ্রহণ করতে পারলেও গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। কারণ তারা খুব অল্প বয়স থেকেই প্রস্তুত কনটেন্টের ভেতরে ডুবে যাচ্ছে। এই সমস্যা শুধু শিশুদের নয়; তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্করাও একইভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। আগে আমরা চিঠি লিখতাম, কবিতা ভাবতাম, গল্প বানাতাম। এখন ইমোজি দিয়ে কথার কাজ সারছি। এতে যোগাযোগ সহজ হলেও ভাষার গভীরতা ও কল্পনার সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রযুক্তিকে একেবারে বর্জন করা সম্ভব নয়, বরং এটিকে আমাদের জীবনের সহায়কশক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। পরিবারে গল্প বলার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হবে, শিশুদের বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। স্কুলে শুধু পড়াশোনার পাঠ নয়, কল্পনা বাড়ানোর কার্যক্রম যেমন নাটক, আঁকাআঁকি, গল্প লেখা, মাঠের খেলাধুলা—এসব কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার শেখাতে হবে। যেমন—শিশু যদি মোবাইল ব্যবহার করে, তবে তাকে শিক্ষামূলক কার্টুন, বিজ্ঞানভিত্তিক গেম, আঁকার অ্যাপ বা গল্প তৈরির টুলসের দিকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। সৃজনশীল চিন্তার বিকাশে প্রয়োজন ভারসাম্য, যেখানে প্রযুক্তি হবে সহায়ক আর বই, গল্প, খেলা, হাতে-কলমের অভ্যাস হবে শক্তির উৎস। কল্পনার বিকাশই আমাদের চিন্তা, মানবিকতা এবং সৃজনশীলতার মূল। কল্পনাশক্তি বৃদ্ধির জন্য শিশুদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মনোভাব তৈরি করতে হবে, বাবা-মায়েদেরও তাদের ব্যস্ততার মধ্যেই সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, খেলা করা, গল্প বলার অভ্যাস তৈরি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কিছু কার্যক্রম রাখা, যা শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
প্রযুক্তি আসলে আমাদের কল্পনাশক্তি কেড়ে নিচ্ছে না; বরং আমাদের অপব্যবহারের কারণে কল্পনাশক্তি হারাচ্ছে। প্রযুক্তি সঠিক ব্যবহার হতে পারে সৃজনশীলতার হাতিয়ার আবার ভুল ব্যবহার হয়ে উঠতে পারে কল্পনার শত্রু। তাই প্রয়োজন সচেতনতা, ভারসাম্য ও সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষক, অভিভাবক এবং তরুণ প্রজন্মকে সচেতন হতে হবে—প্রযুক্তি যেন ভোগের মাধ্যম না হয়ে শেখা ও সৃজনশীলতার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
ফারহানা মৌ ইরিন
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন