সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৪০ এএম
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গৌরবের দীপ্তিতে ঝলসে উঠুক বিজয়

গৌরবের দীপ্তিতে ঝলসে উঠুক বিজয়

আজকাল ইউটিউবের যুগ। ডিজিটাল যুগে সবাই কোনো না কোনো মাধ্যমে নিজেকে হাজির করে। ইউটিউবের কথা বললাম এই কারণে, এ মাধ্যমে এমন কিছু দেখি, যা আমার মতো বয়সী মানুষের হৃৎকম্পের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনই কিছু ভিডিওতে তরুণ-তরুণী এবং বয়স্কজনরা বিজয় দিবস প্রসঙ্গে যা বলেন, শুনলে মাথা খারাপ হওয়ার বিকল্প থাকে না। এক তরুণ বলল, ১৬ ডিসেম্বর ভালোবাসা দিবস। বয়সী একজন সাধারণ নিরীহ মানুষ বললেন, শেখ মুজিব দিবস। আর এক অতি চালাক ভদ্রলোক বললেন, কেন? স্বাধীনতা দিবস। ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। অথচ আমরা এখনো মানুষকে জানাতে পারিনি কোনটা আমাদের বিজয় দিবস।

কয়েক বছর আগে আমি তখন বাংলাদেশে। ১৬ ডিসেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি মাইকে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গানগুলো আমাকে দারুণভাবে কাছে টানে। হয়তো বিদেশে থাকার কারণে মাইকে এসব গান শুনি না বলে টানটা বেশি। সেদিন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম কয়েকটি কারণে, কেউ সেসব গানে মন দেয় না এবং আমি যখন স্নান করে কাপড় পাল্টে সবুজ পাঞ্জাবি পরিধান করে শহীদ মিনারের দিকে যাব যাব করছিলাম, দু-একজন টিপ্পনী কেটে মন্তব্য করেছিল, মনে হচ্ছে দাদা কোনো ধর্মশালায় যাচ্ছে। ৫০ বছর পর আমাদের চিন্তা-চেতনায় বিজয় দিবসে পবিত্র হওয়ার কাজটাও কৌতুকের।

আমি কাউকে দোষারোপ করিনি। করিও না। সেদিন শহীদ মিনারে পৌঁছে দেখি কর্তব্য ও দায় স্বীকারের জন্য দেওয়া বেশিরভাগ ফুলের স্তবকগুলো মাথা নিচু করে পড়ে আছে। তখন ভিড় বলতে কিছু নেই। কয়েকজন তরুণী পাদদেশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি নিজেই তাদের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিয়েছিলাম। দেখলাম একজন ছাড়া বাকিরা এসেছে কারণ তাদের আসতে বলা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এটা তারা জানে কিন্তু কার বিজয়, কে কার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, তা জানে না।

দুপুরে বাসায় ফিরে দেখি টিভিতে অনুষ্ঠান চলছে। একটানা অনেক সময় আমি খবর এবং অনুষ্ঠান দেখার পর জানলাম, আমাদের দেখা বিজয় দিবস আর নেই। ১২-১৩ বছরের যে বালক বিজয় দিবস দেখেছিল, ৬০ বছর বয়সে এসে তাকে জানতে হচ্ছে সে বিজয় দিবস আর আজকের বিজয় দিবস এক নয়। একসময় আমরা আমাদের যৌবনে সেসব শক্তি অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়েছি, যারা ইতিহাস মানতে চাইত না। যারা রেডিও-টিভিতে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুলদের কথা বলতে দিত না। যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নাম বলত না। দালাল-রাজাকারদের নাম বলা ছিল নিষিদ্ধ। আমরা মনে করতাম এরা সরকারে না থাকলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখলাম হয়নি। ১৬ ডিসেম্বরের যে গৌরবগাথা তার সঙ্গে কিছু অনিবার্য নাম আর মানুষ জড়িয়ে। আমি তাদের কোনো নাম বা গল্প শুনিনি।

সব দেশেই রাজনীতি একমুখী নয়। রাজনীতিতে ডিগবাজি বা দল বদলানো, মত বদলানো আছে। কিন্তু তাতে করে ওই মানুষটির ভূমিকা কমে যায় না বা আমার মতের সঙ্গে মেলে না বলে বা আমার সঙ্গে থাকেনি বলে তার ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়ার নজির নেই অন্য দেশে। আমাদের দেশ বড় অদ্ভুত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার থাকার পরও একাত্তরের ৯ মাস এবং বিজয়ের ঘটনা কুয়াশামাখা। আজকাল এ কে খন্দকার বা জেনারেল অরোরার কথা কেউ জানে না। জানে না কর্নেল ওসমানীর নাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতা সৈয়দ নজরুল বা তাজউদ্দীনও নেই। যদি এমন হয় বা হতে থাকে, বিজয় দিবস কীভাবে তার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবে?

বিজয় দিবসের বিকৃতি বা খণ্ডিতকরণই তাকে তার মহিমা বঞ্চিত করেছে। যে কারণে এত বড় মাহাত্ম্যপূর্ণ দিনটি আজ কিঞ্চিৎ হলেও কোণঠাসা। অনেকে মনে করেন, মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের একটা কারণ। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক যত ফিকে হয়েছে, ততই বিজয় দিবসের ওপর তার আঁচড় লেগেছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না কিন্তু ইতিহাস তো বারবার রচিত হয় না। আজকের বাংলাদেশের যে রূপ, যে সমৃদ্ধি তার ভিত্তি তো সেই বিজয় দিবসটি।

ব্রুস এখন আর বেঁচে আছেন কি না, জানি না। লন্ডনের সঙ্গে সময় মিলিয়ে যখন ফোনে পেয়েছিলাম, তখন ওখানে সকাল। কী পরিচয় দেব? কী বলব? এসব দ্বিধা দূরে সরিয়ে সরাসরি বলেছিলাম আমি এক গর্বিত বাংলাদেশি। সিডনিতে থাকি। তাকে বলেছিলাম, আমি জানি তিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস রণাঙ্গনে কাটিয়েছিলেন। মেলবোর্ন এজ পত্রিকার হয়ে ৯ মাস যুদ্ধের খবর কভার করার পাশাপাশি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার পাশাপাশি তাদের একজন হয়ে ওঠা ব্রুস যে বিজয় দিবসে আত্মসমপর্ণের দিন তখনকার রেসকোর্সে ছিলেন, সে কথাও জানিয়েছিলাম তাকে।

ব্যস, তাতেই কাজ হলো। ব্রুস উইলসন শুরুতেই আমাকে চমকে দিয়েছিলেন জন্মগত পরিচয় এবং গোত্র-বর্ণ বিষয়ে তথ্য দিয়ে। আমি যে হিন্দু ধর্মে জন্মেছি, তা নাম ও পদবিতে বোঝা কঠিন নয়; কিন্তু একজন বিদেশি কতটুকু জানলে বলে দিতে পারেন, আমি বৈদ্য সম্প্রদায় নামে পরিচিত বর্ণের কেউ। তা ছাড়া সব কথাতেই আমি বারবার টের পেয়েছিলাম, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, এমনকি জনজীবন বিষয়েও অনেক কিছু তার নখদর্পণে। হাসপাতালের বিছানায় শায়িত ব্রুস ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ওসমানী বা সেই মাপের কেউ সেদিন উপস্থিত না থাকাটা তাদের ভালো লাগেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীনের অনুপস্থিতিও পীড়া দিয়েছিল তাকে। তার ধারণায় পাকিস্তানি বাহিনী বা তারাই চায়নি এমন কিছু। আর ভারত তখন তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সারতে ব্যস্ত। তাদের মাথায় তখনো আমেরিকা-চীনের কথা ঘুরছিল। কারণ পাকিস্তানিদের জন্য এ দুই পরাশক্তি কোনো আক্রমণ শানালে বা যে কোনো কিছু করলে এমন প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে। তাদের অনুমান যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের আনাগোনা। যদিও পরে তারা মাছ ধরার জন্য এসেছিল—এমন ফালতু হাস্যকর অজুহাত দিয়ে চলে গিয়েছিল। ব্রুস মনে করতেন, সেদিন যদি সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনের মতো কেউ থাকতেন, তবে ইতিহাস আরও গতি পেত। অন্যরকম হতো। এত ইতিহাস বিকৃতির শিকার হতো না দেশ।

আজকের বিজয় দিবসে ইতিহাসের পাশাপাশি সত্য তুলে ধরা আর মানুষের কাছে তা পৌঁছানোর বিকল্প দেখি না। যারা তা না জানলে দেশ এগোবে না, তারাই জানে না। জানানো হয় না। একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ছাড়া বা ১৬ ডিসেম্বরকে আড়ালে রাখলে বাংলাদেশের কিছুই থাকে না। নতুন প্রজন্ম আর ইতিহাসের কারণে বাংলাদেশ ও বিজয় দিবস সমার্থক শুধু মুখে, লেখায় বা আচারে নয়, আনুষ্ঠানিকতায়ও না, বিজয় দিবস অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে উঠুক। বয়সের এই প্রান্তে এই আমাদের চাওয়া।

লেখক: ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক। সিডনি প্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা

খালেদা জিয়ার হাসপাতালে ভর্তির কারণ জানালেন চিকিৎসক

ফাইনালে সুপার ওভারে হেরে বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ

বিদেশিদের হাতে বন্দরের ব্যবস্থাপনা তুলে দেওয়া অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত : লায়ন ফারুক

হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় / পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় মেজর সিনহাকে

কর্মী নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশকে সুখবর দিল সৌদি আরব

সোনালী ব্যাংকে ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ দিয়ে প্রতারণা

জাল টাকার নোটসহ আটক ২

রাজশাহীতে ৬ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক

এসএ সিদ্দিক সাজুকে বিএনপির শোকজ

১০

বিএনপি নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বিতা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ : সেলিমা রহমান

১১

মুফতি মামুনুর রশিদ কাসেমী গ্রেপ্তার

১২

রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা উচিত : রিজভী

১৩

যুদ্ধবিরতির মধ্যে গাজায় হামলা, কমান্ডারকে নিহতের দাবি ইসরায়েলের

১৪

রাবির দুই শিক্ষককে বিভাগীয় সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি

১৫

এ দেশ সবার, কারো একার না : সালাউদ্দিন বাবু

১৬

‘স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় না গিয়ে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে ফিরে যান’

১৭

ফাইনাল জিততে বাংলাদেশের দরকার ১২৬ রান

১৮

শাহজাহানের বক্তব্য সমর্থন করে না জামায়াত

১৯

আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’, নামের অর্থ জানুন

২০
X