সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:১৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনীতির রাজনীতি

অর্থনীতির রাজনীতি

গত মঙ্গলবার ঠিকঠাক মতোই দ্বাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। রাজপথের বিরোধীপক্ষের দিক থেকে কালো পতাকা মিছিল পুলিশি হার্ডলাইনে দাঁড়াতেই পারেনি। আরও একবার বোঝা গেল যে, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নিজের অবস্থান সংহত রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো ছাড় দেবেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা বর্তমান সরকার কি পারবেন দেশের অর্থনীতিকে সুশৃঙ্খলায় আনতে?

প্রশ্নটি উচ্চারিত হলো এ কারণে যে, রাজনীতি আসলে দিন শেষে অর্থনীতির শক্ত ভিতের ওপর অবস্থান করে। কালবেলা মঙ্গলবার শিরোনাম করেছে—এই মুহূর্তে কী ম্যাজিক দেখাবেন অর্থমন্ত্রী? শিরোনামই বলে দিচ্ছে টানা চতুর্থবারের জন্য চলমান আওয়ামী লীগ সরকারের পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভার জন্য বড় কাজের জায়গা অর্থনীতি। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে আপাতত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হলেও তা দিয়ে সংকটাপন্ন অর্থনীতির চেহারার এখনো বদল ঘটানো সম্ভব সহজ ও সামান্য কাজ নয়।

দেশের অর্থনীতি নানামুখী চক্রাকার সমস্যার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতির পরিকাঠামো নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। মানুষের হৃদয়ে বড় উন্নয়ন স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছিল অবকাঠামো খাতে সরকারের বড় বড় বিনিয়োগে। কিন্তু চলাচল সহজ করলেও এসব উন্নয়ন প্রকল্প মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটায়নি। নিঃসন্দেহে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বড় প্রভাব রেখেছে, কিন্তু অর্থনীতির বর্তমান সঙ্গিন অবস্থা শুধু এসবের জন্য দায়ী নয়। ঘুরেফিরে কভিড আর পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের ওপর দোষ চাপানো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

যদি বলা হয় নতুন সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ কী? একবাক্যে উত্তর আসবে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরা। এ কথাটি সরকার নিজেও বলছে। সাধারণ মানুষ যখন দিশেহারা, সরকার যখন কার্যকর কিছুই করতে পারছে না, তখন সামনে উপস্থিত রমজান মাস। নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলছেন, এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। এমন কথা যেদিন বলেছেন, সেদিনই পেঁয়াজের দাম কেজিতে শতক পেরিয়েছে।

টাকার দাম পড়ছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। অবস্থা বেগতিক সেই ২০২০ সাল থেকে। কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু খারাপই হচ্ছে বলা যায়। কিছুদিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মসলা, তরকারি, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। মানুষ কম খাচ্ছে, কারণ মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে।

সরকারের সব পরিসংখ্যানই বলছে যে, খুচরা বাজারে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারটা ঠেলে ওপরের দিকে উঠছে। মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসাবের চেয়ে আসল অবস্থা আরও খারাপ। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে। মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের তো অবশ্যই নাভিশ্বাস উঠছে, কিন্তু দাম বাড়ার প্রকোপ গরিব মানুষের ওপর পড়ছে সবথেকে বেশি। এর কারণ, প্রথমত—শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি গরিব মানুষ বাস করে; দ্বিতীয়ত—অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের তুলনায় গরিব মানুষ খাবারদাবারের পেছনে তাদের আয়ের আরও বেশি অংশ ব্যয় করে থাকে। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাদেরই সবচেয়ে ক্ষতি।

খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে কেন? একটা বড় কারণ অবশ্যই মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও কারসাজি। আছে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাও। কিন্তু একটা বড় কারণ তো জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। ২০২২ সালে এক লাফে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সময় বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে কমলে কমানো হবে। এখন কমেছে, কিন্তু সরকার কমাচ্ছে না। অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের জন্য, রাজস্ব আদায়ে নিজস্ব ব্যর্থতার জন্য সরকার কথা রাখল না, বরং মানুষের পকেট থেকে টাকা নিয়েই চলছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়ে, পণ্যের পরিবহন খরচ বাড়ে, কাজেই সব জিনিসেরই দাম বাড়ে। সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ এ জ্বালানি পণ্যের দাম। এটা কমাতে পারলে অনেকখানি কমে আসত পণ্যের দাম। নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং অনেক ব্যবসায়ী নেতা সিন্ডিকেটের কথা বললেও জ্বালানি তেলের প্রসঙ্গ আশ্চর্যজনকভাবে বলছেন না। খাদ্যশস্যের জোগানে টান না পড়লেও দাম কেন কমে না, এর একটা বড় কারণ এই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। জিনিসপত্রের দাম কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়েও কিছু মন্তব্য প্রয়োজন। মূল্যবৃদ্ধি রদ করার সাবেক দাওয়াই সুদের হার বাড়ানো; অথচ সে পথে অল্পই হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাজার শুধু বাজারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। হয়েছে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেও। ব্যাংক এবং আর্থিক খাতে বহুদিন একের পর এক কেলেংকারি ও নীতিবিরুদ্ধ কাজ চলমান আছে। এসব লুটপাট বন্ধ না করলে তার একটা প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়ে, যা শেষ পর্যন্ত পণ্য বাজারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। প্রায় সব ব্যাংকেই তারল্য সংকট। ধার দিয়ে আর টাকা ছাপিয়ে অনেক ব্যাংককে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের হার এমন জায়গায় গেছে, যা আগে কখনো হয়নি। আর্থিক খাতকে সুপথে আনার বড় কাজ হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করা এবং সেই পথে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করা। এই ডিভিশন ব্যাংক খাতে লুট করার পথ সুগম করে রাখছে। কারণ এর মাধ্যমে ক্ষমতা কাঠামোকে ব্যবহার করে সমাজবিরোধীরা ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করে লুটপাট করছে। একই সঙ্গে সঞ্চয় আহরণের পুরো কাজটি ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিয়ে সরকারি সঞ্চয় অধিদপ্তরও তুলে দিতে হবে। একজন একক ব্যক্তির হাত থেকে দেশের ব্যাংকিং খাতকে বাঁচাতে হবে।

দ্রব্যমূল্য কমানোর আরেকটি বড় উপায় হলো ব্যাপক আমদানি করে বাজারে ভারসাম্য আনা। কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না ডলার সংকটের কারণে। ব্যবসায়ী মহলের আর্তনাদ হলো—‘এলসি খুলতে পারছি না, ডলার নেই।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয়িষ্ণু দশা আরও ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। ধারাবাহিক ঘাটতির কারণে এরই মধ্যে দেশে বহুমুখী সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নিত্যপণ্য আমদানি ছাড়া অন্যান্য আমদানিতে চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ মিলছে কম।

সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি এবং সেটার ভারসাম্য আনার কোনো চেষ্টাও দৃশ্যমান নয়। নিপীড়নমূলক পরোক্ষ আয়নির্ভর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নেতৃত্ব নিয়েও ভাবা দরকার। সরকারের রাজস্ব আদায়ে নেই গতি। অর্থবছরের ছয় মাসের হিসাবে এরই মধ্যে ঘাটতি হয়ে গেছে ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সব মিলে সামষ্টিক অর্থনীতি বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

রাজস্ব আয়ে ধস নামার পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অনিয়মে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহেও কোনো ভালো লক্ষণ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নে চলছে স্থবিরতা। টাকার অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা এবং ডলার-সংকটে বিদেশিদের বকেয়া শোধ করতে পারছে না সরকার। একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আছে দেশ। দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিপুল পরিমাণ দেনা নিয়ে বিপাকে পড়েছে। একদিকে তারা টাকার অভাবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে দিতে পারছে না; অন্যদিকে মার্কিন ডলারের অভাবে বকেয়া রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা।

বৈদেশিক ঋণ, মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি, ডলার বাজার, রাজস্ব খাত, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় সর্বোপরি চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বড় সংকটে আছে সরকার। কথা এটাই সত্য যে, এই মুহূর্তে সংকট মোচনের কোনো ম্যাজিক কৌশল অর্থমন্ত্রীর হাতে নেই। আর্থিক খাত (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান), রাজস্ব খাত (শুল্ক-কর ও ভ্যাট), সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা (ব্যালান্স অব পেমেন্ট, মুদ্রাবাজার) নিয়ে খাতভিত্তিক সুচিন্তা করা দরকার এখন।

নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম কাজ হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরানো। সে লক্ষ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ডলারের সংকট দূরীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে সবার আগে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলো যেহেতু বাস্তবায়ন হবে না, সেজন্য এ বাজেটের যৌক্তিক সংশোধন করাও জরুরি। আর্থিক খাত সংস্কার এবং রাজস্ব আদায় বাড়াতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ধরে কাজ করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারায়ণগঞ্জে অপহরণকারী চক্রের ৪ সদস্য গ্রেপ্তার

আ.লীগ নেতা হত্যা মামলার আসামি বন্ধুর ছুরিকাঘাতে খুন

রাবির হলে দুপক্ষের সংঘর্ষ, ছাত্রলীগের ৪ নেতা বহিষ্কার 

ধামরাইয়ে নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করে তালা দিলেন আ.লীগ নেতা

শিক্ষকতার চাকরি খুঁজছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাইফুল

নরসিংদীতে বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা-অগ্নিসংযোগ, টেঁটাবিদ্ধসহ আহত ২০

ঝালকাঠিতে পথসভায় হামলা, চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ আহত ২০

পরিত্যক্ত সবজি থেকে পলিথিন, কলাগাছের তন্তু থেকে প্লাস্টিক তৈরি

ঢাকায় প্রথম দিনে ব্যস্ত সময় কাটালেন ডোনাল্ড লু

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে’

১০

পথচারীদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় সোনালু ফুল

১১

প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে পোস্ট, অতঃপর...

১২

চবি আইইআর ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি কাওসার, সম্পাদক মিমি

১৩

চাল বিতরণে অনিয়ম, ইউপি সদস্য বরখাস্ত 

১৪

কয়রার বাগালী ইউনিয়ন পরিষদের উন্মুক্ত বাজেট সভা

১৫

ভিডিও দেখে আঙ্গুর চাষে সফল আনোয়ার

১৬

ব্যাংক ১ টাকা দিয়ে ১০ টাকার জমি নিতে চায় : রাফসান

১৭

অনিয়মের বেড়াজালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

১৮

তুরস্কে চিকিৎসা নিচ্ছে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা: এরদোয়ান

১৯

গতিসীমার মধ্যে থেকেও ওভারটেকিংয়ের পথ দেখালেন ডিএমপি কমিশনার

২০
X