মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৩৮ এএম
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন

ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন

পৃথিবীর সবকিছুই মহান আল্লাহর সৃষ্টি ও অকৃপণ দান। মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, মানুষের মুখের ভাষাও সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। সৃষ্টির শুরু থেকে হাজারো প্রকার ভাষায় কথা বলে মানুষ। সুরয়ানি, হিব্রু, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, পালি, বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ এমন অসংখ্য ভাষা উচ্চারিত হয়েছে ও হচ্ছে পৃথিবীর বুকে। প্রতিটি ভাষাই মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি। কোনো ভাষাকে ছোট করে দেখার বা তুচ্ছ ভাবার সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং নিপুণতার সঙ্গে প্রত্যেক মানুষকে অন্য মানুষ থেকে আলাদাভাবে তৈরি করেছেন। পাশাপাশি দিয়েছেন রঙের ভিন্নতা, ভাষার ভিন্নতা, দিয়েছেন রুচির বৈচিত্র্য। এর মাধ্যমেই মহান আল্লাহর কুদরত ও অপরূপ মহিমা ফুটে উঠেছে। আর ভাষা বৈচিত্র্যের সাক্ষ্য মেলে খোদ পবিত্র কোরআনে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম : ২২)।

ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। যদি ভাষা না থাকত, তাহলে কী অবস্থা হতো আমাদের, একবার চিন্তা করে দেখুন। সুরা বাকারার ৩১ নাম্বার আয়াত থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর সব জিনিসের নাম, তাদের গুণাবলি এবং তাদের কার্যক্রম শিখিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ সবার আগে তাকে ভাষা ও জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি আদম (আ.)-কে ফেরেশতাদের ওপর মর্যাদা দিয়েছেন। সুরা রুমের ২২ নাম্বার আয়াত থেকে জানতে পারি যে, আল্লাহ যেমন বিভিন্ন ধরনের জাতি সৃষ্টি করেছেন, বিভিন্ন রঙের মানুষ সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমনি তাদের জন্য বিভিন্ন ভাষাও সৃষ্টি করেছেন। আরবি, ফারসি, হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি, তুর্কি ইত্যাদি কত ধরনের ভাষা পৃথিবীতে আছে। এসব ভাষায় কথা বলার সময় লক্ষ করা যায় যে, সবার ঠোঁট, জিহ্বা, কণ্ঠনালি থাকার পরও একেকজন মানুষের গলার স্বর আর উচ্চারণভঙ্গিও একেক রকমের হয়ে থাকে। এই যে এত বৈচিত্র্য, এর মধ্যেই আছে সৌন্দর্য। না হলে তো সৃষ্টির বৈচিত্র্য থাকত না। কল্পনা করুন, যদি বস্তু এবং ধারণাগুলোতে নাম দেওয়ার বিষয়ে আমাদের ভাষাজ্ঞান সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হতো, তাহলে আমাদের হয়তো গরুর বর্ণনা দিতে হতো এভাবে, ‘এমন প্রাণী যার চারটি পা আছে, যা ঘাস খায়, দুধ উৎপাদন করে এবং শিং আছে ইত্যাদি।’ যদি কোনো ভাষাই না থাকত, তাহলে কী হতো? আর তখন যদি ‘ভয়’, ‘লজ্জা’, ‘সাহস’, অথবা ‘ক্ষুধার’ মতো অদৃশ্য ধারণাগুলো বর্ণনা করতে চাইতাম, চিন্তা করে দেখুন, আমাদের জন্য কাজটা কত জটিল হতো। এটা তো আল্লাহর রহমত যে, তিনি আমাদের বিশাল বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন এবং আমরা ‘গরু’, ‘ঘোড়া’, ‘ভয়’, ‘লজ্জা’, ‘প্লেট’ ‘গ্লাস’ ইত্যাদি একেকটা শব্দ দিয়ে মনের অবস্থার কথা বা কোনো বস্তুর কথা বোঝাতে পারি এবং বুঝতে পারি। সুরা রহমানের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাষা’ (অর্থাৎ আদম (আ.)-কে)।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল (আ.) পাঠিয়েছেন। তাদের ওপর যেসব আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছিল, সেগুলোর ভাষা ছিল ওই নবী-রাসুলদের স্বজাতির ভাষা। নবী-রাসুলদের কাছে পাঠানো আসমানি কিতাবসমূহ মাতৃভাষায় অবতীর্ণ না হলে সেগুলো তাদের জাতি ও সম্প্রদায় বুঝতে পারত না। ফলে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত। মাতৃভাষার সঙ্গে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি জড়িত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪)

হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির মাতৃভাষা ছিল সুরিয়ানি, তাই সুরিয়ানি ভাষায় তার প্রতি ইনজিল অবতীর্ণ হয়। হজরত মুসা (আ.)-এর জাতির ভাষা ছিল ইবরানি বা হিব্রু, তাই ইবরানি ভাষায় তাওরাত অবতীর্ণ হয়। হজরত দাউদ (আ.)-এর জাতির ভাষা ছিল ইউনানি, তাই ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় জাবুর অবতীর্ণ হয়। অন্যদিকে মহান আল্লাহ হজরত দাউদ (আ.)-কে দান করেছিলেন সুমধুর কণ্ঠস্বর। ফলে তার ওপর নাজিলকৃত কিতাব পাঠ করার সময় তার কণ্ঠের মোহনীয় সুরের মূর্ছনায় আল্লাহর বাণী শোনার জন্য সাগরের মৎস্যপ্রজাতি কিনারে এসে ভিড় জমাত। আবার সোলায়মান (আ.)-কে মহান আল্লাহ পশুপাখির ভাষাসহ সব জীবের ভাষা বোঝার জ্ঞানদান করেছিলেন। যার মাধ্যমে আল্লাহর নবী সোলায়মান (আ.) তাদের শাসনও করেছেন এবং তাদের কথাবার্তা শুনে বিবদমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। আর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার আগমনাঞ্চলের ভাষা ছিল আরবি, তার প্রথম ও প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিলেন আরবরা, তাই সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোরআনুল কারিম আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়। আসমানি কিতাবসমূহ যদি নবী-রাসুলদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় না হয়ে ভিন্ন ভাষায় নাজিল হতো, তাহলে নিজেদের উম্মতদের দ্বীনের আলোর দিকে আহ্বান করা নবী-রাসুলদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যেত।

শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরবের সম্ভ্রান্ত কোরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃভাষায় তার দক্ষতা ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন ভাষা ও সাহিত্যে সর্বাধিক নৈপুণ্যের অধিকারী, আরবের সবচেয়ে স্পষ্ট ও বিশুদ্ধভাষী। তার বাচনভঙ্গি, মাতৃভাষায় বিশুদ্ধতা এবং উচ্চারণের সুস্পষ্টতা ছিল রাসুল চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী।’ তার মাতৃভাষা আরবি হওয়ায় মুসলমানদের অনুসৃত ধর্মগ্রন্থ কোরআনুল কারিম আল্লাহতায়ালা আরবি ভাষায় নাজিল করেছেন। যেন সুপথভ্রান্ত লোকেরা সহজেই তাওহিদ বা একত্ববাদ স্বীকার করে ইসলামী জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে এবং কিতাবপ্রাপ্ত নবী-রাসুলরা সহজেই দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এরপর আমি এ কোরআনকে আপনার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি। যাতে মুত্তাকিদের এর (বেহেশতের) সুসংবাদ দিতে পারেন, আর এর সাহায্যে কলহে লিপ্ত জাতিকে (দোজখের) ভয় দেখাতে পারেন।’ (সুরা মারিয়াম : আয়াত ৯৭)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘এটা রুহুল আমিন জিবরাইলের মাধ্যমে আপনার অন্তঃকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। যাতে সতর্ককারী হতে পারেন।’ (সুরা শুয়ারা : ১১৩-১১৫)

আল্লাহতায়ালা হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করে তাকে সব ভাষা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশের উপযোগী ভাষা।’ (সুরা আর রাহমান : ২-৩)। হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের কাছে আল্লাহতায়ালার আদেশ-নিষেধ পৌঁছে দেওয়ার পূর্বে আবেদন করেছিলেন, ‘হে আমার প্রভু! আমার জিহ্বা থেকে জড়তার সমাধান করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সুরা তোয়াহা : ২৭-২৮)

মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য যে মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করে সেটা মাতৃভাষা। মাতৃভাষা ছাড়া মানুষ পরিতৃপ্ত হয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। মাতৃভাষা মহান আল্লাহর অনুপম নেয়ামত। মাতৃভাষা চর্চা বা বিশুদ্ধভাবে কথা বলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুপম সুন্নত। যেসব গুণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে অর্থবহ এবং প্রশংসনীয় করে তোলে তার মধ্যে বিশুদ্ধ ভাষা ও সুস্পষ্ট উচ্চারণ অন্যতম। পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারের বেশি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। সবার ভাষা এক নয়। জাতি ও মানচিত্রভেদে একেকজন একেক ভাষায় কথা বলে। বিচিত্র এসব ভাষায় বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ কথা বলে। এ ভাষাগুলোই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের মাতৃভাষা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত—রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন।’ হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত—রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী; কোরাইশ গোত্রে আমার জন্ম।’ হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত—রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে তার স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ) তিনি আরও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু কথা জাদুময়।’ (বোখারি শরিফ)

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারায়ণগঞ্জে অপহরণকারী চক্রের ৪ সদস্য গ্রেপ্তার

আ.লীগ নেতা হত্যা মামলার আসামি বন্ধুর ছুরিকাঘাতে খুন

রাবির হলে দুপক্ষের সংঘর্ষ, ছাত্রলীগের ৪ নেতা বহিষ্কার 

ধামরাইয়ে নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করে তালা দিলেন আ.লীগ নেতা

শিক্ষকতার চাকরি খুঁজছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাইফুল

নরসিংদীতে বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা-অগ্নিসংযোগ, টেঁটাবিদ্ধসহ আহত ২০

ঝালকাঠিতে পথসভায় হামলা, চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ আহত ২০

পরিত্যক্ত সবজি থেকে পলিথিন, কলাগাছের তন্তু থেকে প্লাস্টিক তৈরি

ঢাকায় প্রথম দিনে ব্যস্ত সময় কাটালেন ডোনাল্ড লু

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে’

১০

পথচারীদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় সোনালু ফুল

১১

প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে পোস্ট, অতঃপর...

১২

চবি আইইআর ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি কাওসার, সম্পাদক মিমি

১৩

চাল বিতরণে অনিয়ম, ইউপি সদস্য বরখাস্ত 

১৪

কয়রার বাগালী ইউনিয়ন পরিষদের উন্মুক্ত বাজেট সভা

১৫

ভিডিও দেখে আঙ্গুর চাষে সফল আনোয়ার

১৬

ব্যাংক ১ টাকা দিয়ে ১০ টাকার জমি নিতে চায় : রাফসান

১৭

অনিয়মের বেড়াজালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

১৮

তুরস্কে চিকিৎসা নিচ্ছে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা: এরদোয়ান

১৯

গতিসীমার মধ্যে থেকেও ওভারটেকিংয়ের পথ দেখালেন ডিএমপি কমিশনার

২০
X