জি এম সোহরাওয়ার্দী
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৪, ০২:২০ এএম
আপডেট : ১৪ মে ২০২৪, ০৭:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভূমিহীনমুক্ত জেলা-উপজেলা ঘোষণা কতটা বাস্তব

ভূমিহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। ছবি : সংগৃহীত
ভূমিহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। ছবি : সংগৃহীত

‘মুজিব শতবর্ষ’ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষমহল থেকে একটি প্রশংসনীয় ঘোষণা ছিল বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না। উন্নয়নের রোলমডেল বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের মাথার ওপর নিজের এক টুকরো চালা আর পায়ের তলায় একটুখানি মাটি না থাকা বড়ই বেমানান! কাজেই সরকারি সেই ঘোষণা অনেকের কাছেই সাধুবাদ পেয়েছিল।

আর দশটা সরকারি ঘোষণার মতো এটি শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং ঘোষণার বাস্তবায়নে সরকারি প্রশাসন (স্থানীয় সরকার সহকারে) দেশব্যাপী বিশাল কর্মযজ্ঞে নেমে পড়ে। ফলে সরকারি ভাষ্যমতে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প (আশ্রয়ণ-২) বাস্তবায়িত হয় এ দেশে। পাশাপাশি সরকারের শীর্ষমহল থেকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত জেলা-উপজেলা ঘোষিত হতে থাকে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ‘বদলে যাওয়া দৃশ্যপট’ শীর্ষক ওয়েব প্রকাশনার ৩০ নং পৃষ্ঠায় ২১টি জেলা এবং ৩৩৪টি উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয় (ওয়েবসাইটে এখনো প্রদর্শিত হচ্ছে)। একই বছরের ১৪ নভেম্বর জাতীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারলাম নতুন ঘোষিত ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত জেলা-উপজেলা মিলিয়ে মোট ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত জেলা-উপজেলার সংখ্যা যথাক্রমে ৩২ ও ৩৯৪। অর্থাৎ দেশের অর্ধেক জেলা আর বেশিরভাগ উপজেলাই এখন ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত। এ ধারা চলমান থাকলে আশা করা যায় অচিরেই বাংলাদেশ ভূমিহীনমুক্ত হয়ে যাবে!

মাত্র চার বছরের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক সংখ্যায় ভূমিহীন মানুষ হ্রাস সরকারের জন্য একটি মেগা সাফল্য বটে! সর্বশেষ ২০১৯ সালের কৃষি শুমারিতেও বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) গ্রামীণ খানার প্রায় ৮ ভাগ (৭.৮৪%) তথা ২৩ লাখের বেশি (২৩,২৩,২৭০) নিরঙ্কুশ ভূমিহীন খানার (যাদের মালিকানায় কোনো ভূমি নেই) তথ্য দিয়েছিল। এর সঙ্গে আপেক্ষিক ভূমিহীন খানা (যাদের মালিকানায় দশ শতক পর্যন্ত আবাসভূমি ও অন্যান্য জমি থাকলেও কোনো কৃষিভূমি নেই) যুক্ত করলে মোট গ্রামীণ ভূমিহীন খানার সংখ্যা হতো কয়েকগুণ বেশি।

অর্থাৎ সরকারি তথ্য-উপাত্তের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট সরকারি ঘোষণার অমিল সহজেই চোখে পড়ে। ভূমিহীন মানুষ ছাড়াও এ গবেষণায় গ্রামের অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, সাংবাদিক, উন্নয়নকর্মী, ভূমি অধিকারকর্মী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার) এবং ইউনিয়ন ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই (একজন ভূমি কর্মকর্তা ছাড়া) ভূমিহীনমুক্ত জেলা-উপজেলা ঘোষণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তাদের মতে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ ভূমিহীন এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ভূমিহীনতার সমস্যা আগামীতে আরও তীব্র হবে।

গবেষণাধীন গ্রামগুলোতে অর্ধেকের বেশি (৫৬.২৫%) খানাই ভূমিহীন। এদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগের ওপর খানা (১২.৯২%) নিরঙ্কুশ ভূমিহীন আর ৪০ ভাগের ওপর (৪৩.৩%) খানা আপেক্ষিক ভূমিহীন। স্বাভাবিকভাবেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর (নারী প্রধান খানা, আদিবাসী খানা প্রভৃতি) মাঝে ভূমিহীনতার প্রকোপ বেশি। গবেষণাধীন গ্রামগুলোতে নারীপ্রধান খানার এক-চতুর্থাংশ (২৫%) নিরঙ্কুশ ভূমিহীন আর এক-তৃতীয়াংশের বেশি (৩৭.৫%) খানা আপেক্ষিক ভূমিহীন; অর্থাৎ গ্রামীণ নারীপ্রধান খানার ৬০ ভাগের বেশি (৬২.৫%) ভূমিহীন।

এ দৃশ্যমান বাস্তবতার বিপরীতে সরকারের ভূমিহীনমুক্ত জেলা-উপজেলা ঘোষণার কারণ কী? গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বা তথ্য প্রদানকারীরা এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন। বেশিরভাগই এ ক্ষেত্রে ‘দুই শতক জমির ওপর ঘর প্রদান’কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। ভূমি কর্মকর্তারা দাবি করেন ভূমিহীনের তালিকা অনুযায়ী দুই শতক জমির ওপর ঘর প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তালিকা অনুযায়ী সবাইকে ঘর প্রদান সম্পূর্ণ হলেই বলা যায় সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন বা উপজেলা ভূমিহীনমুক্ত। কেননা ঘরের পাশাপাশি দুই শতক জমিও যে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু এ দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি! প্রথমত উল্লিখিত ভূমিহীনের তালিকাটিই ত্রুটিপূর্ণ। প্রকৃত ভূমিহীনদের অনেকেরই (বর্তমান গবেষণানুযায়ী, অন্তত ৪০ ভাগ) এ তালিকায় স্থান হয়নি। আবার অর্থ ও ক্ষমতার (রাজনৈতিক ও সামাজিক) প্রভাবে ভূমিহীন নয়, অবস্থাসম্পন্ন অনেকেই এ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। অর্থাৎ গোড়াতেই রয়েছে গলদ। দ্বিতীয়ত দুই শতক আবাসভূমি দিয়ে দরিদ্র কৃষকের ভূমিহীনতা দূর হয়েছে বলে যারা দাবি করেন, তারা এ সংক্রান্ত সরকারি নীতিকেই অগ্রাহ্য করতে চান (যেখানে এর পাঁচগুণ বেশি অর্থাৎ ১০ শতক পর্যন্ত অকৃষি জমি থাকলেও সেই খানার মালিকানায় যদি কৃষিজমি না থাকে, তাহলে তাকে ভূমিহীন খানা বলা হচ্ছে!)। অর্থাৎ সরকারের নিজের তৈরি নীতি লঙ্ঘনের একটি বিপজ্জনক উদাহরণ এখানে তৈরি হচ্ছে!

গ্রাম-বাংলায় ভূমিহীন আর দরিদ্র মানুষ সমার্থক। মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে এ ব্যাপক সংখ্যায় ভূমিহীন মানুষ বিরাজমান থাকা ঠিক সংগতিপূর্ণ নয়। তাই সরকার তার নিজস্ব স্টাইলে ভূমিহীনতা দূর করছে—এমন অভিমত দিয়েছেন গবেষণায় অংশগ্রহণকারী অনেকেই। ভূমিহীন মানুষসহ সাধারণ গ্রামবাসীর অভিমত, ‘সরকার দেশকে ইউরোপ-আমেরিকা-সিঙ্গাপুর বানাতে চায়; সেখানে ভূমিহীনের ঠাঁই নেই।’ স্থানীয় নাগরিক সমাজ বিশেষত উন্নয়নকর্মী এবং ভূমি অধিকারকর্মীরা মনে করেন জাতীয় (পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা) ও আন্তর্জাতিক (এসডিজি) নানা লক্ষ্য পূরণে সরকারের এ প্রয়াস। কেউ কেউ মনে করেন, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য পূর্বেকার ‘নিরক্ষরমুক্ত আলোকিত মানিকগঞ্জ’, ‘ভিক্ষুকমুক্ত মুন্সীগঞ্জ’ প্রোপাগান্ডার মতোই এটি আরেকটি প্রোপাগান্ডা।

ভূমিহীন মানুষ ও তাদের নিয়ে কর্মরত ভূমি অধিকারকর্মীদের বড় অংশের অভিমত দরিদ্র ভূমিহীন মানুষকে খাসজমি-জলার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার জন্য এ উদ্যোগ। ভূমিহীন মানুষই যদি না থাকে, তাহলে তাদের খাসজমি-জলা বরাদ্দ দেওয়ার প্রশ্নই তো অবান্তর! এরই মধ্যে ভূমি অফিস ও অন্যান্য সরকারি অফিসে তাদের এরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

পেছনের বা ভেতরের কারণ যাই হোক, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সরকার দেশকে ভূমিহীনমুক্ত না করে ক্ষান্ত হবে না! এ হচ্ছে সমাজকে ‘দারিদ্র্যমুক্ত’ না করে ‘দরিদ্র (মানুষ)মুক্ত’ করার সর্বনাশা উন্নয়ন দর্শন! এ ক্ষেত্রে মনে রাখা চাই যে, ‘আজকের’ ভূমিহীনদের বড় অংশই ‘গতকালের’ খুদে কৃষক আর ‘আগামীকাল’ এরাই ক্ষেত-মজুরের ‘অন্তিম কৃষি পরিচয়’লয় করে, ভিড় করবে শহরের অনানুষ্ঠানিক খাতে, ঠাঁই নেবে বস্তিতে। গবেষণায় একজন ভূমিহীন নারী তাই সখেদে বলেছেন, ‘(সরকারি ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা) ঠিকই আছে; গ্রাম একদিন ভূমিহীনমুক্ত হবে, যেদিন আমরা আর (গ্রামে) থাকব না!’

লেখক: উন্নয়ন গবেষক ও সেন্টার ফর নলেজের সমন্বয়কারী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্বেচ্ছায় কারাগারে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা

অলিম্পিকে পদকের লড়াই হবে যে ইভেন্টগুলোতে (২৭ জুলাই)

দক্ষিণ আমেরিকা নিয়ে নতুন ছক সৌদির

রাশিয়ার সাবেক উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গ্রেপ্তার

ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে?

মানামার বাতাসে দূষণ সবচেয়ে বেশি, ঢাকার পরিস্থিতি কী

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার বর্জ্যে দুর্ভোগে ৩ লাখ মানুষ

স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

অলিম্পিকে নিষিদ্ধ ছিল যে দেশগুলো

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১০

উদ্বোধনীতে অ্যাথলেটদের চেয়ে বেশি উৎফুল্ল বাংলাদেশের কর্তারা

১১

কুষ্টিয়ায় নাশকতা মামলায় আ.লীগ নেতার ছেলে গ্রেপ্তার

১২

৬ দিন পর বরিশাল-ঢাকা রুটে লঞ্চ চলাচল শুরু

১৩

ভেজানো ছোলা খাওয়ার উপকারিতা

১৪

হামলা মামলা ও লাঞ্ছনার শিকার লালমনিরহাটের ৬ সাংবাদিক

১৫

কলেজছাত্রীকে বিবস্ত্র, লজ্জায় আত্মহত্যা

১৬

প্যারিসের আলোয় উদ্ভাসিত অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

১৭

ট্রলার উদ্ধারে গিয়ে ডুবল স্পিডবোট, সৈকতে ভেসে এল ২ মরদেহ

১৮

সিলেটে ‘অবৈধ’ নিয়োগে প্রভাষক জালিয়াতিতে অধ্যক্ষ!

১৯

সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী শনিবার

২০
X