মানুষ সাধারণত পার্থিব সফলতাকেই প্রকৃত সফলতা মনে করে। অথচ দুনিয়ার এ সফলতা ক্ষণস্থায়ী। একদিন শেষ হয়ে যাবে। প্রকৃত সফলতা হচ্ছে পরকালের সফলতা। যে এটা অর্জন করবে সেই প্রকৃত সফল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সুতরাং যাকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই হবে প্রকৃত সফল। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮৫)। একজন মুমিনকে সফলতা অর্জন করতে হলে যেসব গুণাবলি অর্জন করতে হবে, আল্লাহতায়ালা তা কোরআনে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।
শিরক থেকে মুক্ত থাকা: আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না। কারণ শিরক হচ্ছে অমার্জনীয় অপরাধ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের অসংখ্য জায়গায় বান্দাকে শিরকের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার আদেশ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না।’ (সুরা নিসা : ৩৬)
নম্রভাবে চলাফেরা করা: নেককার ব্যক্তিরা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে। গর্বভরে চলে না, অহংকারীর ন্যায় পা ফেলে না। অহংকারের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে চলে না। দুনিয়ার প্রথম পাপ বা গোনাহের সৃষ্টি হয়েছে এ অহংকারের মাধ্যমে। অহংকারের মাধ্যমেই ইবলিশ চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত হয়েছে। প্রকৃত মুমিন গর্বিত স্বৈরাচারী ও বিপর্যয়কারীর মতো নিজের চলার মাধ্যমে নিজের শক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা না করা। বরং তাদের চালচলন হয় ভদ্র, মার্জিত ও সৎস্বভাব সম্পন্ন ব্যক্তির মতো। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার অন্তরে তিল পরিমাণ অহংকার থাকবে; সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যার অন্তরে তিল পরিমাণ ইমান রয়েছে সে জাহান্নামে যাবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৯১)
মূর্খদের এড়িয়ে চলা: মুমিন বান্দাদের সঙ্গে যখন কোনো জাহেল লোক কথা বলে তখন তারা বলে সালাম জানিয়ে চলে আসে। জাহেল মানে অশিক্ষিত বা লেখাপড়া না জানা লোক নয় বরং এমন লোক যারা জাহেলি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, যদিও তারা আক্ষরিক অর্থে জ্ঞানী হয়। আল্লাহর বান্দাদের পদ্ধতি হচ্ছে, তাদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করলে তারা গালির জবাবে গালি এবং দোষারোপের জবাবে দোষারোপ করে না। হয়তো চুপ থাকে নয়তো মার্জিত ভাষায় উত্তর দেয়। কোরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যখন তারা কোনো বেহুদা কথা শোনে, তা উপেক্ষা করে যায়। বলে, আমাদের কাজের ফল আমরা পাব এবং তোমাদের কাজের ফল তোমরা পাবে। সালাম তোমাদের, আমরা জাহেলদের সঙ্গে কথা বলি না।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৫৫)
রাত জেগে ইবাদত করা: আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে। রাতের ইবাদতকারীর জন্য আল্লাহতায়ালা কল্যাণের দ্বার খুলে দেন। এর মাধ্যমে বান্দা প্রভুর প্রেমে গভীর রাতে আরামের শয্যা ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়। এ নামাজ মুমিনের মন ও চরিত্রকে নির্মল ও পবিত্র করে। ইবাদতে রাত্রি জাগরণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ এই যে, এ সময়টি নিদ্রা ও আরামের। এতে সালাত ও ইবাদাতের জন্য দণ্ডায়মান হওয়া যেমন বিশেষ কষ্টকর, তেমনি এতে লোকদেখানো ও নাম-যশেরও আশঙ্কা নেই। এজন্য রাসুল (সা.) তার প্রিয় সাহাবাদের রাতের ইবাদত (তাহাজ্জুদ) পড়ার জন্য তাগিদ দিতেন। আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদের বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রশংসা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে—‘তাদের পিঠ বিছানা থেকে আলাদা থাকে, নিজেদের রবকে ডাকতে থাকে আশায় ও আশঙ্কায়।’ (সুরা সাজদাহ : ১৬)
সম্পদ ব্যয়ে পরিমিতিবোধ : আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না আর কৃপণতাও করে না; এ দুইয়ের মধ্যবর্তী পন্থা গ্রহণ করে।’ (সুরা ফোরকান : ৬৭)। অপব্যয় ও কৃপণতা—এ দুটির মাঝে সমতা রক্ষা করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে ঘোষণা করেছেন। অপচয় ও অপব্যয়ের কারণে মানুষের জীবন থেকে বরকতও হ্রাস পায়। এর ফলে মানুষের ধন-সম্পদ ক্রমে হ্রাস পায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আহার করো ও পান করো; কিন্তু অপব্যয় করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)
খুন-খারাবি থেকে মুক্ত থাকা: মুমিন ব্যক্তি কখনো খুন-খারাবিতে লিপ্ত হতে পারে না এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না। মানবহত্যা ও ব্যভিচার আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত পাপ। মানবহত্যার পরকালীন বিধান সম্বন্ধে কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রূষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৯৩)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহর চেয়ে রাগী আর কেউ নেই, তিনি রাগ করেন তার সেই বান্দা-বান্দির প্রতি, যারা ব্যভিচার করে। আল্লাহর শপথ, আমি যা জানি যদি তোমরা তা জানতে, তাহলে অবশ্যই কম হাসতে এবং বেশি বেশি কাঁদতে!’ (বোখারি, হাদিস : ১০৪৪)
মিথ্যা পরিহার করা: আল্লাহর সৎ বান্দাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা জেনেশুনে সব ধরনের মিথ্যা কথা বা এ ধরনের মজলিসে উপস্থিত হয় না এবং আজেবাজে কথা ও কাজ দেখা বা শোনা অথবা তাতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। হাদিসে মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
নেক আমলে মনোনিবেশ: আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ শুধু নিজের নেক আমল ও নিজের সংশোধন নিয়েই তৃপ্ত থাকেন না। বরং তাদের পরিবার পরিজনের সংশোধনের ব্যাপারেও সচেষ্ট থাকেন। এদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন—‘আর যারা প্রার্থনা করে; হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন, যারা আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেবে আর আমাদের মুত্তাকিদের ইমাম বানিয়ে দিন।’ (সুরা ফোরকান : ৭৪)
লেখক: ইমাম ও খতিব