সারা দেশে জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ৬০১টি স্ক্রিনিং কেন্দ্র স্থাপন করে ৫০ লাখের বেশি নারীর স্ক্রিনিং করা হয়েছে। এসব পরিচালনায় ৬৯ জন চিকিৎসক-কর্মচারী আছেন। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু গত সোমবার কর্মস্থলে গিয়ে কর্মীরা দেখেন তারা চাকরি হারিয়েছেন। তাদের হাজিরার বায়োমেট্রিক যন্ত্রটিও বন্ধ। এদিকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা এদিন সকালেই বিদেশে পাড়ি জামিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের অন্তত ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছেন পিডি। তার দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেই সবাইকে চাকরিচ্যুত করেছে প্রশাসন।
গত রোববার অফিসের সামনে লাগানো নোটিশে বলা হয়েছে, ‘৩০ জুন থেকে কল্পোকপিস্ট, সহকারী সার্জন, গবেষণা সহকারী, বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার, ভাইরোলজিস্ট, সহকারী প্রোগ্রামার, ডিভিশনাল কো-অর্ডিনেটর, জেলা কো-অর্ডিনেটর, সার্ন, প্যারামেডিকসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ৩০ জুন থেকে বাতিল করা হলো।’
এমন নোটিশ দেখে মঙ্গলবার চাকরি হারানো কর্মীরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর গতকাল বুধবার চাকরি ফিরে পেতে তারা কর্মস্থলে গেলে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তাদের বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। তখন তারা সেখানে বসে পড়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ‘ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু-মুখ ও স্তন ক্যান্সার নির্ণয় কর্মসূচি’ শীর্ষক প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৮ সালের জুনে। এর মেয়াদ ছিল ২০২১ সাল পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ মেয়াদের দুইবার সংশোধন ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২৪-২৫ মেয়াদের নো-কস্ট এক্সটেনশনের মাধ্যমে ফের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনবল নিয়োগকালে পিডি অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা তাদের জানিয়েছেন, প্রকল্পের জনবলের জন্য সরকার থেকে বেতন ছাড়া অন্য কোনো ভাতা বা সম্মানী দেওয়া হয় না। তবে প্রকল্প সমাপ্তিতে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন করে নিয়োগ পাওয়া সবাইকে আত্মীকরণ করা হবে। কিন্তু গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর পিডি হঠাৎ করেই জানান বর্তমান প্রশাসন তার অনুকূলে না থাকায় তিনি স্থায়ীকরণের ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন না। তখন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিএসএমএমইউ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। প্রকল্পের বিভিন্ন কাগজপত্র জোগাড় করতে গিয়ে তারা দেখতে পান, প্রকল্পের শুরু থেকে মূল বেতন ছাড়াও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য ক্যাম্পে সম্মানী বাবদ প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর জন্য অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। এরপর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু করেন। কিছু নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৭ কোটি টাকার বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে সরকার থেকে উত্তোলন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গত ৭ অক্টোবর লিখিতভাবে পিডিকে জানিয়ে সব কর্মীর ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু পিডি প্রাপ্য প্রদানে অস্বীকার করেন। তিনি তখন জানান, প্রকল্প পরিচালনায় নানাবিধ হিসাববহির্ভূত ব্যয় যেমন, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ডেস্ক ‘ম্যানেজ করা’, অডিট সামলানো, গাড়ি ভাড়া ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ নিয়ে কথা বাড়ালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনি চাকরিচ্যুতির হুমকিও দেন।
কল্পোকপিস্ট সাদিয়া মাহবুব বলেন, বিএসএমএমইর উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে এবং তার সঙ্গে সশরীরে দেখা করে প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করা হয়। উপাচার্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং সিন্ডিকেট সভায় আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে সেগুলোর কিছুই হয়নি।
সাদিয়া মাহবুব বলেন, বিষয়টি নিয়ে বিএসএমএমইউ পরিচালকের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে এ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মকারীদের জুন, ২০২৪ থেকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেখানো হবে। আমরা বুঝতে পারি, অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ডা. আরও সাদিয়া বলেন, আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে যখনই জানিয়েছি, আমাদের কাছে সব প্রমাণ আছে, কিন্তু তারা সময়ক্ষেপণ করে ডা. আশরাফুন্নেসাকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন।
এ নিয়ে কথা হয় বিএসএমএমইউর রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সব কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। তা ছাড়া এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রকল্প নয়। বিশ্ববিদ্যালয় এর সঙ্গে যুক্তও নয়। এ প্রকল্প বন্ধ করে দিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে।