

দেশের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য সমুদ্রবন্দর দিয়ে কয়লা পরিবহনের বিপরীতে রক্ষণাবেক্ষণ ফি নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এ অবস্থার অবসানে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বৈঠকে বসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ছাড়াও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তা বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
গত বছরের মে মাসে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে সমুদ্রবন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ ফি আদায় বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই মূলত এই ফি আদায় নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। মূলত জাহাজ চলাচলের চ্যানেলের নাব্য ঠিক রাখতে এই ফি চেয়েছে দেশের সবকটি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লাবোঝাই জাহাজ বন্দরে ভিড়লেও ফি পরিশোধ না করায় কয়লা খালাসে বাধা দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরে বিদ্যুৎ সচিবের মধ্যস্থতায় বিশেষ ব্যবস্থায় কয়লা খালাস করা হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নাব্য ঠিক রাখতে রক্ষণাবেক্ষণ ফি আদায় করা হলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামে। তারা আরও বলেন, দেশের বন্দরগুলোর চ্যানেলের যে পরিমাণ নাব্য থাকা প্রয়োজন, সেটা নেই। যে কারণে বড় জাহাজ থেকে কয়লা খালাসে ছোট ছোট লাইটারেজ জাহাজ ব্যবহার করতে হয়। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের খরচ অনেক বেশি হয়। এ অবস্থায় বন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ ফি পরিশোধ করতে হলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প থাকবে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেডের (আরএনপিএল) জন্য ৫৬ হাজার ৬১৪ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি জাহাজ ভেড়ে পায়রা বন্দরে। তবে দাবি অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ ফি হিসেবে টনপ্রতি ৭ দশমিক ৭১ মার্কিন ডলার পরিশোধ না করায় সে সময় জাহাজকে কয়লা খালাসে বাধা দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরে বিদ্যুৎ সচিবের মধ্যস্থতায় সেই জাহাজের কয়লা খালাস করা হয়। পরে গত ১২ জানুয়ারি চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণের ফি ছাড়াই কয়লা খালাসের জন্য পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম ভূঁইয়া। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি পরিশোধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য পিডিবিকে পত্র দেওয়া হয়েছে। পিডিবি থেকে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি ছাড়া অন্য সব ফি পরিশোধ করে কয়লা আনলোড করতে ইচ্ছুক তারা। চিঠিতে আরও বলা হয়, যদি চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি না পরিশোধ করার কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ কয়লা আনলোডিং কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলে, তাহলে আরএনপিএলকে উচ্চ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যা রাষ্ট্রের ক্ষতি বলে বিবেচিত হবে।
আরএনপিএলের এক কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে পটুয়াখালী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৬০ থেকে ৭২টি কয়লাবোঝাই জাহাজ আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এ হিসেবে বছরে ৩৬০ কোটি টাকা চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি পরিশোধ করতে হবে। এর আগে গত ১৯ নভেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফের সভাপতিত্বে চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি আদায় বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের মালিকানাধীন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি বাবদ ৮৩৯ কোটি ৬৫ লাখ ৯ হাজার ২২১ টাকা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। এই টাকা ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি হিসেবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে। এ ছাড়া মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি বাবদ চারশ কোটি টাকা দাবি করেছে।