শাহনেওয়াজ খান সুমন
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চনপাড়া চরে ইকোপার্ক বানিয়ে নদী ধ্বংসের আয়োজন

বাধাগ্রস্ত হবে গতিপ্রবাহ আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
চনপাড়া চরে ইকোপার্ক বানিয়ে নদী ধ্বংসের আয়োজন

রাজধানীর ডেমরায় সুলতানা কামাল সেতুর উত্তর দিকে নদীর মাঝখানে চনপাড়া চর। পশ্চিম দিকে বালু নদ আর পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী। চরটি থেকে একটু দক্ষিণে বালু নদ এসে মিশেছে শীতলক্ষ্যায়। লম্বায় ৯০০ মিটার ও প্রস্থে ২০০ মিটারের এ চরে হেঁটে যাতায়াতের জন্য নদী ভরাট করা হচ্ছে। দুই নদনদীর মাঝে জেগে ওঠা চরটিকে ফোরশোর (তীরভূমি) দেখিয়ে আট কোটি টাকা ব্যয়ে ইকোপার্ক নির্মাণ করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। পার্ক নির্মিত হলে দুই নদীর নাব্য ও স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ স্থায়ীভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইকোপার্ক নয়, চরটি খনন করে নৌ-চলাচলের উপযোগী করে দিলে নদী রক্ষায় কার্যকর হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় জেলা প্রশাসন থেকে বাওয়ানী জুট মিল চরটি ইজারা নিয়েছিল কারখানায় উৎপাদিত পণ্য শুকানোর জন্য। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মালিকপক্ষ দেশ থেকে চলে যায়। এরপর থেকে চরটি সেভাবেই রয়েছে। চরের উত্তর দিকের শেষ মাথা থেকে নদীর পাড় পর্যন্ত নাব্য সংকটে নৌ-চলাচল বন্ধ রয়েছে। এক সময় বড় বড় নৌযানে জমজমাট থাকত বালু আর শীতলক্ষ্যা। এখন বাল্কহেড আর ট্রলার চলে বেশি।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, চরটিতে ইকোপার্ক নির্মাণের জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা চলছিল। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের নির্দেশের পর তা বাস্তবে রূপ পেয়েছে। গত বছরের ১৩ নভেম্বর ইকোপার্ক নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন উপদেষ্টা। এর কিছুদিন আগে শীতলক্ষ্যা নদী পরিদর্শনে গেলে চনপাড়া চরটি নজরে আসে উপদেষ্টার। তখন কর্মকর্তারা উপদেষ্টাকে জানান, ইকোপার্ক নির্মাণ করা হলে চরটি সংরক্ষণ করা যাবে। পরে বিআইডব্লিউটিএকে উদ্যোগ নিতে বলেন নৌ উপদেষ্টা। বিআইডব্লিউটিএর চলমান প্রকল্প ‘নদীপাড় সংরক্ষণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও সৌন্দর্যবর্ধন’-এর আওতায় চরটিতে ইকোপার্ক নির্মাণকাজ চলছে জোরেশোরে।

সরেজমিন দেখা যায়, ইকোপার্ক নির্মাণের জন্য নদী থেকে বালু উত্তোলন চলছে। উঁচু করে চর ভরাটের পাশাপাশি ইট দিয়ে পিলার নির্মাণের কাজ করছেন শ্রমিকরা। তারা জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নয়, বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ইকোপার্ক নির্মাণ হচ্ছে। চরের উত্তর দিকের শেষ মাথায় নদী ভরাট করার জন্য কিছু মাটি রাখা হয়েছে। বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে কিছু অংশ।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা চরে শাকসবজি চাষ করছিলেন। গত বছরের নভেম্বর মাসে হঠাৎ তাদের ফসল নষ্ট করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক শারাফাত ইসলাম কায়েস বলেন, সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান পলিন ও তার পিএস শাহিন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। ১২ লাখ টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। সে সময় উপদেষ্টা আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার। পরে আমরা আর ক্ষতিপূরণ পাইনি।

বিআইডব্লিউটিএর বন্দর ও পরিবহন বিভাগের পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘চনপাড়া চরটি দীর্ঘদিন অযত্নে পড়ে ছিল। শুষ্ক মৌসুমে চরটি জেগে উঠলে স্থানীয়রা এখানে মৌসুমি সবজি চাষ করত। বিভিন্ন অপরাধও সংঘটিত হতো এখানে। নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা চরটি নিয়ে কী করা যায় জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেখানে একটি ইকোপার্ক হলে স্থানীয়রা উপকৃত হবেন আর চরটিও অপরাধমুক্ত হবে। বিস্তারিত শুনে ইকোপার্ক নির্মাণের নির্দেশ দেন উপদেষ্টা।

চরকে ফোরশোর হিসেবে দেখানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চনপাড়া চর খাসজমি। এটা একই সঙ্গে বালু ও শীতলক্ষ্যার ফোরশোর বিবেচনায় নিয়ে আমরা জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করেছি। হাইকোর্ট নদীর ফোরশোরে ইকোপার্ক নির্মাণের জন্য বিআইডব্লিউটিএকে নির্দেশনা দিয়েছেন। সে আলোকেই আমরা একটি চমৎকার ইকোপার্ক নির্মাণ করছি।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের সংযোগস্থলে অবস্থিত চরটিতে কোনো তীর নেই। এটিকে কোনোভাবে ফোরশোর দেখানোর সুযোগ নেই। বালু নদে মালবাহী অনেক নৌযান চলে। এই ছোট চরটি যদি খনন করে দেওয়া হয়, তাহলে নদীর প্রবাহ ঠিক থাকে। নদীর স্বার্থে এই চরটি কেটে দেওয়া সর্বোত্তম কাজ।

তিনি বলেন, ইকোপার্ক মানে হলো জীববৈচিত্র্যবান্ধব পার্ক। এ চরে তো ইকো নেই, গাছ নেই, প্রাণী নেই। এখানে ইকোপার্ক বানানোর মানে হলো নদীকে মেরে ফেলার পথ আরেকটু সুগম করা। বিআইডব্লিউটিএ নদীবিধ্বংসী কাজ করছে।

বিআইডব্লিউটিএর অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি চরটি পরিদর্শন করে এসেছি। বালু ও শীতলক্ষ্যার উজান থেকে বহন করে আসা পলি সেখানে জমা পড়ে গেছে। পলি সরিয়ে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা না করা হলে জমাটটি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে এবং পুরো চ্যানেলটা বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন অধ্যাদেশ ১৯৫৮ অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএর কাজ হলো নাব্য রক্ষা করা। ইকোপার্ক করার দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়নি। অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহনের স্বার্থে চরটি খনন করে দেওয়া বিআইডব্লিউটিএর কাজ ছিল।

জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন কালবেলাকে বলেন, নদীর মাঝখানে চরের জায়গাটি বিআইডব্লিউটিএর আওতাধীন। অরক্ষিত অবস্থায় থাকলে জায়গাটি যে কোনো সময় দখল হয়ে যেতে পারে। সেখানে জঙ্গল ছিল, তা পরিষ্কার করা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন যাতে সেখানে গিয়ে বসতে পারে, ঘোরাফেরা করতে পারে, সেজন্য ইকোপার্ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এতে নদীর পাড়টি আরও সুন্দর হবে। আশপাশের লোকজনের জন্য একটি বিনোদনকেন্দ্র হবে। নির্মাণকাজ শেষ হলে পার্কটি উদ্বোধন করা হবে। পরে টেন্ডারের মাধ্যমে কাউকে এটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশি সন্দেহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মারধর

মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে কান্না করলে কি কবরে আজাব হয়?

কবিতার ছন্দে সুনেহরা-আরশের মিষ্টি কথোপকথন

রাগবির ধাঁচে ক্রিকেটারদের এবার নেওয়া হবে ‘ব্রঙ্কো’ টেস্ট!

‘ডাকসুতে দাঁড়াইছে সবাই, বসে আছে একজনই’

সাতক্ষীরা-৪ আসনে কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর রাখার দাবিতে বিএনপির স্মারকলিপি

জকসুর দাবিতে জবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি

স্ত্রীকে নোরা ফাতেহির মতো বানাতে না খাইয়ে রেখে ব্যায়াম করান স্বামী

‘ভুল’ আংটি দিয়ে প্রেমিকাকে ‘প্রপোজ’ করেন রোনালদো!

ঢাকা ও সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফের সংঘর্ষ, স্থায়ী সমাধান চান রমনার ডিসি

১০

বসুন্ধরা শপিংমলে ক্লাব হাউসের ফেস্টিভ কালেকশন উন্মোচন

১১

কালো তালিকাভুক্ত হলেন ৭১ শিক্ষক

১২

দায়িত্ব নিয়েই হুঁশিয়ারি দিলেন সারোয়ার আলম

১৩

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইআরআইর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

১৪

পাকিস্তানের সঙ্গে ভিসা অব্যাহতি চুক্তি অনুমোদন

১৫

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসির রোডম্যাপ এ সপ্তাহে আর ঘোষণা হচ্ছে না

১৬

ভরা মৌসুমেও ইলিশ নেই, হতাশ জেলেরা

১৭

গাজীপুরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ

১৮

জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করলেন তামিম

১৯

পেছনের পকেটে মানিব্যাগ রাখেন? অজান্তেই ডেকে আনছেন যে অসুখ

২০
X