আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুনভাবে সদস্য সংগ্রহ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে ‘ডোর টু ডোর’ তথা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের কাছে যেতে চায় দলের হাইকমান্ড। এরই মধ্যে ছয়টি সাংগঠনিক বিভাগে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। দীর্ঘ আট বছর পর এবার বিএনপির টার্গেট নতুনভাবে কোটি সদস্য সংগ্রহ করা। এরপর নতুন-পুরোনোদের নিয়ে ডিজিটাল তালিকা বা তথ্যভান্ডার তৈরি করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এদিকে নতুন সদস্য সংগ্রহ করার বিষয়ে গত বুধবার রাতে বিএনপির নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সদস্য ও ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের সঙ্গে দুই ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক (ভার্চুয়াল) করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ প্রায় ৮০ জন সাবেক ছাত্রনেতা উপস্থিত ছিলেন। রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তারেক রহমান প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। বিএনপি নেতারা জানান, গত দেড় দশকে তিনবার সদস্য নবায়ন এবং সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচির উদ্যোগ নিলেও ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে আন্দোলনের কারণে তা শেষ করতে পারেনি বিএনপি।
জানা গেছে, আগামীকাল শনিবার ও রোববার বিএনপির সদস্য পদ নবায়নে গঠিত কমিটি এবং বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক হবে। এরই মধ্যে প্রতিটি বিভাগের জন্য কমিটি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অধিকাংশ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি শাখার জন্য একজন করে প্রতিনিধি নির্ধারণ করা হবে। সারা দেশে বিএনপির সাংগঠনিক শাখা ৮২টি। ফলে ৮২টি তদারকি টিম বা কমিটি গঠন করবে বিএনপি। এসব কমিটির প্রধান হবেন সাবেক ছাত্রনেতা। তবে অন্যবারের মতো যে কেউ চাইলেই সদস্য ফরমের বই ইচ্ছামতো কিনতে পারবেন না; বরং নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সদস্য বই কিনতে পারবেন। অর্থাৎ বিগত সময়ে অনেকেই নিজেদের অবস্থান জানান দিতে অনেক সদস্য বই কিনে নিতেন। বিশেষ করে যারা সংসদ সদস্য প্রার্থী তারা এটি করেছেন। কিন্তু যে পরিমাণ বই বা সদস্য ফরম বিক্রি হতো সে অনুযায়ী সদস্য সংখ্যা বাস্তবে নেই। এ জন্য এবার সদস্য বই বিক্রির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের নজরদারি থাকবে। পাশাপাশি বিএনপির সদস্য ফরম যেন আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীর হাতে না যায়, সেটিও নিশ্চিত করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালবেলাকে বলেন, আমাদের দলের সদস্য নবায়ন ও সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেখানে যেন কোনো আওয়ামী লীগ না থাকে, এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে। কারণ এটা পরীক্ষিত, আওয়ামী লীগের কেউই ভালো না। আওয়ামী লীগ নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কারও স্বার্থ দেখতে পারে না। তিনি বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ নেব না, কিন্তু যারা ভালো মানুষ তাদের বাদও দেব না। আওয়ামী লীগের যারা প্রমাণিত খারাপ মানুষ, মাফিয়া, দখলদার, ডাকাত, তাদের দলে নেওয়া যাবে না। তবে যারা রাজনীতি করেনি, খারাপ না, ভালো মানুষ, তাদের বাছাই করে দলে নেওয়ার কথা বলেছি।
জানা গেছে, নির্বাচনী দাবি-দাওয়া, দল পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযানে যাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। মূলত তিনটি কারণে সারা দেশে দলীয়ভাবে নেতাকর্মীদের প্রাথমিক সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ করা হবে। এই তিন কারণ হলো- ১. আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জনশক্তিকে সক্রিয় করা, ২. দলের জন্য বৈধ তহবিল সংগ্রহ ও বৃদ্ধি করা এবং ৩. দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফেরানো। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সদস্য পদ নবায়নের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরপর ওই কার্যক্রমের জন্য গত ২৭ জানুয়ারি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন, আহ্বায়ক রুহুল কবির রিজভী, সদস্য সচিব এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত, সদস্য অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, তাইফুল ইসলাম টিপু, মুহাম্মদ মুনির হোসেন, তারিকুল আলম তেনজিং ও আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী।
এর আগে ২০১৭ সালের ১ জুলাই রাতে প্রাথমিক সদস্য পদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযানের উদ্বোধন করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই সময়ও অন্ততপক্ষে এক কোটি সদস্য সংগ্রহের টার্গেট নিয়েছিল বিএনপি এবং কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের সদস্য সংগ্রহ অভিযানে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘গতবার আমাদের সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ লাখ। এবার আমাদের টার্গেট এক কোটি। সবাই সদস্য হোন, দলের জন্য কাজ করুন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় ৮০ জন সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে নতুন সদস্য সংগ্রহ করার বিষয়ে তারেক রহমান অনেকের কাছে জানতে চান। বেশ কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা বক্তব্যও দেন। একপর্যায়ে তারেক রহমান বলেন, আমরা সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে। এ সময় জামায়াতে ইসলামী সদস্য সংগ্রহের বিষয়টিও উঠে আসে। কেউ বলেন, জামায়াত নেতাদের স্ত্রী-কন্যারাও তাদের দলের সদস্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু বিএনপিতে ক্ষেত্র বিশেষে নারী নেতৃত্বও নেই! ফলে সদস্য সংগ্রহ জোরদার করতে হবে। এ সময় ছাত্রদলের সাবেক একজন সহসভাপতি বিএনপির বর্তমান কার্যক্রমের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপির অনেক নেতা বিভিন্ন এলাকায় পতিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ছেন। অথচ বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি আওয়ামী লীগের বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক থাকার দাবি জানিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, বাড়ি বাড়ি ও মানুষের কাছে গিয়ে নির্দিষ্ট ফিসের বিনিময়ে সদস্য সংগ্রহ করা হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে এবং ওয়ার্ডে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। একই সঙ্গে সদস্য বইয়ের মুড়ি সংগ্রহ করে কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল কালবেলাকে বলেন, বিএনপির নতুন সদস্য সংগ্রহ করার বিষয়টি চলমান আছে। আরও সুন্দরভাবে দ্রুততার সঙ্গে সেটি করার জন্য সাবেক ছাত্রনেতাদের নিয়ে একটি সভা হয়েছে। কিছু কমিটিও গঠন করা হবে।
গত ২০ জানুয়ারি সদস্য পদ নবায়ন কর্মসূচির উদ্বোধনকালে নিজের সদস্য পদ নবায়ন করেন তারেক রহমান। সে সময় তিনি বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চাই জনগণের সমর্থন পাব। দল পুনর্গঠনের পর আমরা রাষ্ট্রকেও পুনর্গঠন করব। ৩১ দফা কার্যকর করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য আছেন প্রায় ৭০ লাখ। তবে এ নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এবার নতুনভাবে শুরু হওয়া সদস্য নবায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাথমিক সদস্যসহ দলীয় নেতাকর্মীদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করতে চায় বিএনপি। এ বিষয়ে কাজও শুরু হয়েছে।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তারিকুল আলম তেনজিং কালবেলাকে বলেন, বুধবারের বৈঠকে বিএনপির সদস্য সংগ্রহ করার বিষয়ে নতুন বিভাগীয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সবই ডিজিটাল মাধ্যমে হচ্ছে।
মন্তব্য করুন